করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা
করোনাভাইরাসের প্রভাবে পুরো দুনিয়াজুড়ে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে তা থেকে রেহাই পায়নি শিক্ষাব্যবস্থাও। উন্নত দেশগুলোতে অনলাইন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম ঢিমেতালে এগিয়ে নিলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবল শ্রেণীকক্ষভিত্তিক পাঠদান ব্যবস্থায় নির্ভরশীল হওয়ায় এই স্থবিরতা জেঁকে বসেছে এখানে প্রকটরূপে।
আর তাই এই সময়টায় এই বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কর্তৃপক্ষ, যদিও বিদ্যমান বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলো সাময়িক সমাধান দিতে পারলেও বড় পরিসরে এর কার্যকারিতা অতটাও ফলপ্রসু হবে না। এক্ষেত্রে আরেকটি সাময়িক সমাধান হতে পারে বিশ্বের উন্নত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিদ্যমান পাঠ্যসূচীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দূরশিক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করা। উদাহরণস্বরূপ এমআইটি ওপেন কোর্সওয়্যার, হার্ভার্ড কিংবা স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির কথা বলা যায়।
তবে এই দুর্যোগকাল থেকে উত্তরণের পরপরই আমাদের উচিত হবে কীভাবে নিকট ভবিষ্যতে দৈনন্দিন শিক্ষাব্যবস্থায় ভার্চুয়াল শিক্ষাদানকে ব্যবহার করা যেতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। আর এর জন্য বৃহৎ পরিসরে এবং দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে একে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সাথে অঙ্গিভূত করে নেয়া যেতে পারে সেই লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় বিবর্তনের ধারাটা ঘটে থাকে খুব ধীর গতিতে, কিন্তু পরিবর্তনটা যখন আসে হঠাৎ করেই আসে। আর এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই মূহুর্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে ঠিক করতে হবে তার ভবিষ্যৎ গতিবিধি কী হবে। ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তনের ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব হবে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সহযোগিতায় সেটা অনুমেয়; কিন্তু সেই বিবর্তনটা কিভাবে হবে সেটা হচ্ছে ভাবনার বিষয়।
এক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত এই লকডাউনের ফলে ঘটে যাওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিজিটাল মাধ্যমে ক্লাস নিয়ে যে আপদকালীন সমাধান বের করতে চাচ্ছেন সেটা নিয়ে কাজ শুরু করার মাধ্যমে উচিত হবে, ভবিষ্যৎ শিক্ষা ব্যবস্থায় বিবর্তনের সূত্রপাত ঘটানো।
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইবে তাদের নিজস্ব শিক্ষকদের প্রস্তুতকৃত বিষয়বস্তুসমূহ দিয়ে অনলাইন পাঠ্যক্রম ব্যবস্থা চালু করবার জন্য; কিন্তু আমাদের অনেক শিক্ষকেরই কীভাবে অনলাইনে ক্লাস নিতে হবে সে ব্যাপারে কোন ধারণা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত হবে তাই এখন এদিকটায় দৃষ্টি দেয়া যে, কিভাবে ন্যূনতম শ্রম এবং প্রচেষ্টায় বিদ্যমান কোর্সগুলোকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করা যায়।
যেমন দুই ঘন্টার একটি ক্লাস লেকচার শুধুমাত্র গৎবাঁধা একগুঁয়ে ভিডিও দিয়ে না করে সেটাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে শিক্ষার্থীদের নিকট চিত্তাকর্ষক করার জন্য। অর্থাৎ গৎবাঁধা ভিডিও কনফারেন্সের ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ক্লাস লেকচারগুলোতে কিভাবে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ আনন্দদায়ক ও ফলপ্রসূ করে তোলা যায় সেদিকে মনোনিবেশ করতে হবে যেন এই বিবর্তনটি স্থায়ীত্ব লাভ করে।
যেহেতু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামোগতভাবে দূর্বল, তাই দূরশিক্ষণ কিংবা অনলাইন পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটা এখানে অপ্রতুলই বলা চলে। আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর খুব নগণ্যই অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যায় এবং সেইসাথে আমাদের অধিকাংশ শিক্ষক এই ধরণের ব্যবস্থার সাথে প্রায় অনভ্যস্ত বলা চলে। তবে এটা যে শুধু প্রশাসন এবং শিক্ষকদের ব্যর্থতা সেটা কিন্তু নয়, আমাদের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার যে মূল অবকাঠামো সেটাতেই আসলে গলদ।
করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাব দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছে যে, থ্রিজি কিংবা ফোরজি নেটওয়ার্কের আওতায় আসার দাবি আসলে কতটা অসাড়। দেশের বিশাল একটা এলাকাতেই এখনো টুজি স্পিডে নেট পেতে হাপিত্যেশ করতে হচ্ছে অনেকের। এছাড়াও স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে বেশকিছু পিছুটান, সেইসাথে শিক্ষার্থীদের একটা ব্যাপক অংশেরই নেই নিজস্ব ল্যাপটপ কম্পিউটার, যা আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে বৃহৎ পরিসরে ডিজিটাল ব্যবস্থায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে বাঁধা হতে পারে।
তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির এই সময়ে এটা আসলে খুবই তুচ্ছ একটা সমস্যা। আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তারা চাইলেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে এর সমাধান করা সম্ভব। এছাড়াও আজকের দিনে আমাদের অধিকাংশের হাতে স্মার্টফোন থাকে, ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তরের সময় সেদিকে লক্ষ্য রেখে যদি পাঠ্যসূচী প্রস্তুত করা যায় তবে এই সমস্যার সমাধান অনেকাংশেই সম্ভব হবে।
প্রাথমিক অবকাঠামো এবং পাঠ্যসূচী প্রণয়নের মধ্য দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান চাইলে স্বল্প পরিসরে নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে যথাযথ সমন্বয়ের এবং আগ্রহের। কীভাবে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা হবে এবং কীভাবে এর মূল্যায়ন হবে সেই দায়িত্ব যদি শিক্ষকদের কাছে দিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘কেন্দ্রীয় একাডেমিক ইনোভেশন সেন্টার’ এর বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেয়, তবে অনেক কাজই সহজ হয়ে যাবে।
বর্তমানে প্রায় সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্ভার ব্যবস্থার মুখাপেক্ষী হতে হয়, যার মানে দাঁড়ায় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক সক্ষমতা রয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরের। এক্ষেত্রে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিযুক্ত সেলের কার্যক্রমকে প্রসারিত করে এই ‘কেন্দ্রীয় একাডেমিক ইনোভেশন সেন্টার’-এর কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এই ‘কেন্দ্রীয় একাডেমিক ইনোভেশন সেন্টার’ শিক্ষকদের পরামর্শ অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে কোর্সগুলোকে অনলাইনে রূপান্তর করবেন, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অন্তর্ভূক্তকরণ শ্রম এবং ব্যয় উভয়ই হ্রাস করবে।
একটা সময় অনলাইনে ক্লাস করা ব্যাপারটা আমাদের কাছে যেখানে কল্পনার মত ছিল সেটাই এখন এই মহামারীর সময়টাতে আমাদের কাছে এক ভিন্নরূপে এসে ধরা দিয়েছে জরুরি প্রয়োজন হিসেবে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং নিরবিচ্ছিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের লক্ষ্যে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে সরকারী নীতিনির্ধারকদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যা আমাদের করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন ধারা সূচনা ঘটাবে এক নতুনের পথে। হয়তোবা এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই সম্ভব হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবার লক্ষ্যে নবউদ্যমে পথচলা।
লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ,
নোয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
zahidul.shourav@gmail.com