করোনাভাইরাস ও মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স এর গবেষণায় জানা গেছে, চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সংক্রমণ ঘটায় ‘ও’ (‘O’) টাইপ নভেল করোনাভাইরাস, সার্স-কোভ-২। ‘ও’ (‘O’) টাইপ করোনাভাইরাস থেকে জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত A2, A2a, A3, B, B1-সহ মোট দশ ধরণের করোনাভাইরাস গঠিত হয়েছে (তথ্যসূত্রঃ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক টাইপটি হচ্ছে--‘এ২এ’ ('A2a')। বিশ্বের বেশির ভাগ ভৌগোলিক এলাকাতেই ২০২০ সালের মার্চের শেষ নাগাদ থেকে নভেল করোনাভাইরাসের ‘এ২এ’ টাইপ আধিপত্ত বিস্তার করেছে।
ভাইরাস হচ্ছে, আবরণ বিশিষ্ট জেনেটিক বস্তু/উপাদানের মাইক্রোস্কপিক প্যাকেজ। জেনেটিক বস্তু/উপাদানটি ডিএনএ বা আরএনএ (DNA or RNA) হতে পারে। এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA ভাইরাস পরিবার যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (নাক, গলা, ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। RNA অর্থ Ribonucleic acid (রাইবোনিউক্লিক এসিড)।
ডিএনএ (DNA) ও আরএনএ (RNA) উভয়েই জীবকোষের জেনেটিক বস্তু/উপাদান। ডিএনএ হচ্ছে- দুইটি স্ট্র্যান্ড বিশিষ্ট অণু (two-strand molecule) এবং তা জীবের গঠনের ও বিকাশের সকল ও অসংখ্য জেনেটিক কোড (ব্লু প্রিন্ট) ধারণ করে। ডিএনএ তে ধারণকৃত বিভিন্ন জেনেটিক কোড আরএনএ বহন করার মাধ্যমে জীবদেহে বিভিন্ন প্রোটিন তৈরি করে, যা জীবদেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশের জন্য দায়ী। অন্যদিকে, আরএনএ হচ্ছে- একটি স্ট্র্যান্ড বিশিষ্ট অণু (one-strand molecule), যা অল্প কিছু জেনেটিক কোড বহন করে।
নভেল করোনাভাইরাসের বৃত্তাকার কাঠামোর ভিতরের দিকে থাকে আরএনএ এবং বাহিরের দিকে থাকে লিপিড ও প্রোটিনের আবরণ। ৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের "ন্যাচার" জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, সংক্রমণের সময়, নভেল করোনা (সার্স-কোভ-২) ভাইরাসের বাহিরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিন মানুষের শ্বসনতন্ত্রের কোষের প্রোটিনের এসিই২ রিসেপটর/এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ রিসেপটর এর সাথে সংযুক্ত হয়। ভাইরাসকে মানুষের কোষের ‘রিসেপটর’ গ্রহণ করে, যেমনটা একটি তালা একটি চাবিকে গ্রহণ করে। মানুষের কোষের তালার "চাবির ছিদ্র" কে নভেল করোনাভাইরাস চাবির মত ব্যবহার করে ভিতরে প্রবেশ করে। মানুষের কোষের এই ধরণের তালার "চাবির ছিদ্র" -- এসিই২ রিসেপটর (এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ রিসেপটর) এর সাথে তুলনীয়।
ভাইরাসটি এমনিতে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। তার কাজ শুরু হয়, মানব কোষে প্রবেশ করার পর। নভেল করোনাভাইরাসের আরএনএ সামান্য জেনেটিক কোড বহন করার কারণে তারা টিকে থাকার জন্য মানুষ বা অন্য প্রাণীর কোষের অঙ্গাণুগুলোর উপর সম্পূর্নভাবে নির্ভরশীল। নভেল করোনাভাইরাস মানুষের কোষে প্রবেশের পরে নিজেদের আরএনএ এর অল্প জেনেটিক কোডের মাধ্যমে মানব দেহ কোষের অঙ্গাণুগুলো হাইজ্যাক করে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং নতুন প্রোগ্রাম সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের কোষকে "ভাইরাস সৃষ্টির কারখানায়" পরিণত করে (তথ্য সূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল পরমাণু শক্তি এজেন্সি)। ভাইরাস কোষে রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করে এবং ব্যাপক ধ্বংসকার্য করে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট "সায়েন্স" ও "লাইভ সায়েন্স")।
যখন বহিরাগত এন্টিজেন; যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করে, দেহের লিম্ফোসাইটস নামক রোগ প্রতিরোধী ইমিউন কোষগুলো "এন্টিবডি" তৈরির মাধ্যমে সাড়া দেয় এবং এন্টিজেনের সাথে লড়াই করে। "এন্টিবডি" হচ্ছে প্রতিরক্ষামূলক প্রোটিন। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, একজন সুস্থ মানুষ এন্টিজেন দ্বারা আক্রান্তের সময় প্রতি দিনে দশ লক্ষ এন্ডিবডি তৈরি করতে পারে এবং এই এন্টিবডিগুলো এন্টিজেনের সাথে কার্যকরভাবে লড়াই করে।
অ্যান্টিবডি হল প্রতিরক্ষামূলক প্রোটিন জাতীয় পদার্থ, দেখতে অনেকটা ইংরেজি Y -আকৃতির। অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের সাথে বিক্রিয়া করে এগুলোকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করে। ভবিষ্যতের জন্য মেমরি কোষও তৈরি হয়ে থাকে যেন ভবিষ্যতে অনুরূপ ভাইরাস প্রবেশ করলে দেহ তাৎক্ষণিক ভাবে প্রতিরক্ষা করতে পারে। অ্যান্টিবডি আবার সাধারণত দুই প্রকার; IgM এবং IgG। জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরে প্রথমে IgM অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিছুকাল পড়ে তৈরি হয় IgG।
যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয় এবং ফুসফুসে ভাইরাস সাংঘাতিক রুপ ধারণ করে (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। ভাইরাস প্রবেশের পর ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে কোষগুলোকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে।
মানুষভেদে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভিন্ন হয়। সেকারণে ভাইরাসে কেউ কেউ আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়, আবার অনেকে হয় না। এটি মানবদেহের এন্টিবডি নামক রোগ ধ্বংসকারী প্রোটিন তৈরির সক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। খাদ্যাভাস সহ জীবনযাত্রার সঙ্গে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সুষম খাদ্য গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, শিম বা ডাল জাতীয় প্রোটিনসহ ভিন্ন জাতীয় (Diversity) শাকসবজি ও ফলমূল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ নিশ্চয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। Diversity অর্থাৎ "ভিন্নতা"; এটি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে একই জাতীয় খাদ্যে উপকারী সকল উপাদান থাকে না।
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক উপায়ে (সূর্যের আলো, মিল্ক ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার) বা সংযোজিত মেডিসিন হিসেবে ভিটামিন ডি এবং অন্যান্ন ভিটামিনগুলো প্রাকৃতিক খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। নিয়মিত পরিমিত ঘুম ও পর্যাপ্ত ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। কারণ দূর্বল শরীর দূর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। যেহেতু ধুমপান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি করে; সেকারণে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ধুমপান বর্জন করতে হবে। স্থুলতা ও ডায়াবেটিস রোগ (রক্তে অতিরিক্ত সুগার) দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েব সাইট 'লাইফ সায়েন্স')। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, দেহের রোগ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সুস্থ জীবনযাত্রার (অর্থাৎ সুষম খাদ্যাভ্যাসসহ পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ পরিহার, ধুমপান ত্যাগ, স্থুলতা ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি) গুরুত্ব রয়েছে।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়