করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য দায়ী চীন

  © ফাইল ফটো

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণে ২৮-০৪-২০২০ তারিখ পর্যন্ত প্রায় ২,১০,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। একটি অদৃশ্য মহামারি ছোবলের আজ সারা বিশ্ব। থেমে গেছে মানুষের সকল কর্মকান্ড। সবাই মনে করছে ভাইরাসের বাহক বাদুড় এ জন্য দায়ী।

এর মধ্যে আজ আন্তর্জাতিক পাখি সংরক্ষণ সংস্থা Birdlife International এর একটি খবরে জানা যায়, পৃথিবীর অনেক দেশে করোনা ভাইরাসের ধারক বাদুড় মারা হচ্ছে। এতে বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণবাদী মানুষের হৃদয়কে আঘাত করেছে। যত দোষ নন্দ ঘোষ। করোনাভাইরাস সংক্রমণের মূল Hotspot পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অবৈধ জীবন্ত ও মৃত বন্যপ্রাণীর ক্রয় বিক্রয়ের জন্য খ্যাত চীনের উহান প্রদেশের বাইশাঝাউ বাজার বা wet market (চীনা ভাষায় ye wei)।

আমরা সকলে জানি করোনাভাইরাস একটি জুনোটিক (Zoonotic) রোগ এবং এ নিয়ে সারা দীর্ঘদিন যাবৎ বিশ্বে গবেষণার কাজ করে যাচ্ছে আমেরিকার EcoHealth Aliance নামে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। জুনোটিক রোগ হলো সে সকল রোগ যা বন্যপ্রাণী হতে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে IEDCR, প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের সাথে One Health কর্মসূচী বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের দেশে এ প্রতিষ্ঠানটি সাফল্যজনকভাবে নিপাভাইরাস নিয়ে কাজ করেছে এবং কাঁচা খেজুরের রসের মাধ্যমে রোগ ছড়ানো বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে আসছেন।

আমরা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবাদী গোষ্ঠি বরাবর বলে আসছি বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে মানুষ- বন্যপ্রাণীর মধ্যে চলাফেরা ও বসবাসের দুরত্ব কমে যাওয়ার ফলে জুনোটিক ব্যাধি মানুষ ও গৃহপালিত প্রাণীর মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এর মধ্যে রেবিস, ইবোলা, নিপাভাইরাস, সোয়ান ফ্লু, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, H5N1 I Covid-19 উল্লেখযোগ্য।

EcoHealth Aliance উহানে দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়ের উপর কাজ করেছে এবং প্রায় ৪০০ ভাইরাসের স্ট্রেইন সনাক্ত করেছে। EcoHealth Aliance এর প্রেসিডেন্ট পিটার ডাসজাক এর ২০১২ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় এক আউন্স ওজনের চাইনিজ হর্সস বাদুড় (Chinese Horse Shoe Bat) প্রথম Covid-19 ভাইরাস সনাক্ত হয় এবং এই বাদুড়টি ধারক (Reservoir) প্রাণী হিসাবে চিহ্নিত হয় তবে মাঝারি বাহক হিসাবে কাজ করেছে তা এখনো সনাক্ত হয়নি। আমার সুযোগ হয়েছিল ২০১২ সালে উহানের বাসাঝাউ বাজার পরিদর্শনের। এ বাজারে আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ বিপন্ন ও মহাবিপন্ন অনেক জীবন্ত বন্যপ্রাণীর এবং বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মাংস, চামড়া, হাড়, দাঁত ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। যাতে করে যে কোন হৃদয়বান লোকের গা শিউরে উঠে। আমি গেøাবাল টাইগার ফোরামের সদস্য ও ফোকাল পয়েন্ট হিসাবে চীনের প্রতিনিধিদেরকে বাঘের চামড়া ও হাড় বিক্রয় বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে একাধিকবার প্রস্তাব করেছি। কিন্তু এতে সায় মিলেনি এবং চীনের বন্ধুরা আমাদের বলেছেন তাদের দেশের বিভিন্ন খামার ও চিড়িয়াখানায় ৪ সহ¯্রাধিক বাঘ আছে। সুতরাং এ ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না বলে অভিমত প্রকাশ করেছে।

বিগত ০৮-০৪-২০২০ তারিখে চীনের কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে দেখলাম করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বাজারে জীবন্ত মাংসাশী প্রাণী যেমন : কুকুর, বিড়াল, বাঘ, চিতা বাঘ, বেজী, গন্ধগকুল, শিয়াল, বাঘদাস ইত্যাদি ক্রয় বিক্রয় বন্ধ করা হয়েছে। এতে আমি মোটেও আনন্দিত হলাম না। বর্তমান মহামারির সংকটের সূতিকাগার বাইশাঝাউ বাজার হয়তো সীমিতভাবে বন্ধ হবে কিন্তু এতে কি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা হবে? এর আগেও চীনারা ভালো করে জানেন ২০০২ সালে সার্স কভ ভাইরাসটি সংক্রমিত হয় ধারক প্রাণী China-rufous Horseshoe Bat ও বাহক প্রাণী গন্ধগকুল এর মাধ্যমে তখন ২৮টি দেশে ছড়ায় এবং ৭৭৪ জন লোক মারা যায়।

২০১২ সালে MERS সৌদিআরবের জেদ্দা থেকে ২৭টি দেশে উটের মাধ্যমে ছড়ায় ৮৫৮জন লোক মারা যায়। তাই সারা পৃথিবীতে বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপ করা হলেও চীনের ক্ষেত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ট্রাফিক (TRAFFIC) প্রদত্ত তথ্য মতে দেখা যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর পাচার ও বাজারজাতকরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু বাসাঝাউ ওয়েট মার্কেট। সুতরাং এ মহামারির দায় দায়িত্ব চীন সরকারকে বহন করেত হবে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাদুড় নিধন করলেই চলবে না। বন ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সুরক্ষা করতে হবে। বন্যপ্রাণী প্রকৃতি ও পরিবেশের অংশ এদেরকে বাদ দিয়ে চলা যাবে না। আসুন আমরা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সমূহ সংরক্ষণ করি এবং বন্যপ্রাণী ধরা, মারা ও শিকার বন্ধ করি। বন্যরা বনে সুন্দুর এই হউক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্লোগান।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাণী বিজ্ঞান সমিতি ও প্রাক্তণ উপ-প্রধান বন সংরক্ষক


সর্বশেষ সংবাদ