০৮ মে ২০২০, ১১:৫৩

এবিপি: সম্ভাবনাময় আগামী নাকি ষড়যন্ত্রের চোরাগলি?

  © ফাইল ফটো

অতি সম্প্রতি 'জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ' নামক রাজনৈতিক উদ্যোগটি 'আমার বাংলাদেশ পার্টি' নামে আত্বপ্রকাশ করল। জামায়াতের নানান স্তরের নেতাদের এই নয়া রাজনৈতিক দল নিয়ে বেশ চাপা গুঞ্জন। প্রকাশ্যে কেউই আমলে নিতে চান না কিন্তু ভিতরে ফিসফাস ঠিকই চলছে।

আমার বাংলাদেশ পার্টি নামটা বেশকিছুটা কিশোর সুলভ রোম্যান্টিসিজমে মোড়া, রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে ঠিক যায় না। তবে এদের সংক্ষিপ্ত অংশ এবিপি শুনতে বেশ চমৎকার, সহজে উচ্চারণযোগ্য। এই মুহুর্তে প্রতিবেশী ভারতের নানান আলোচিত পার্টির সাথে মিল খায়। তাই প্রাথমিক অবস্থায় ধরে নেয়া যায়, এই নাম মোটামুটি একট মার্কেট ভ্যালু তৈরি করবে।

ফেসবুকের মাধ্যমে জানলাম জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের এই নামে একটা বই রয়েছে। তাহলে নামের মধ্য দিয়েই কি এবিপি তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশ করল - এটা একটা প্রশ্ন । যদিও এবিপি বলছে সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে তারা দল পরিচালনা করবে, এমনকি এখন পর্যন্ত এই দলের মূল ব্যক্তি হিসাবে যাকে দেখে এসেছি সেই মজিবুর রহমান মঞ্জু তার বক্তব্যে বলেছেন সারাদেশের নানান অঞ্চলের নানান ধর্মের লোকজনের সাথে আলোচনা করেই তারা সবকিছু ঠিক করেছেন।

তবে সকল ধর্মের প্রতিনিধিত্বের যে কথা বলা হয়েছে সেটা রূপক অর্থে কিনা তা একটা ভাববার বিষয়। তারা কি আধুনিকতার খোলসে ইসলামপন্থী দল হবে না আসলেই সকল ধর্মের মানুষের জন্য ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে একটি কমন প্ল্যাটফর্ম হতে পারবে এটি একটি বড় প্রশ্ন। শিবির এবং জামায়াতের রাজনীতি করে আসা নেতৃত্ব আসলেই ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা এ নিয়ে জোরালো সন্দেহ বিদ্যমান। দল গঠনের সংবাদ সম্মেলনে শুধুমাত্র একটি ধর্মের (ইসলাম) পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঠ করার ঘটনা এই ইঙ্গিতই দেয় যে তারা এখনো তাদের দলে ইসলাম বাদে অন্যান্য ধর্মানুসারীদের মেলবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেননি।

জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশকে গত এক বছরে দুইটা বিপরীতধর্মী প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। গত এক বছরের কর্মকান্ডে দেশের সুশীল এবং কট্টর নাগরিকদের কাছে এই দুই প্রশ্ন সন্দেহে পরিনত হয়েছে। দেশের সুশীল সমাজের একটা অংশ মনে করছেন, জামায়াত আদর্শিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াতে এটা জামায়াতের ট্রান্সফর্মারিক প্লাটফর্ম। অর্থাৎ, নতুন মোড়কে পুরনো জামায়াত। অপরদিকে জামায়াতের অনেক কর্মী-সমর্থক কিংবা ইসলামিক মনোভাবাপন্নরা মনে করেন, এবিপি চলমান সরকার, দেশের ডিপ স্টেটের একটি শক্তিশালী অংশের এমনকি পাশ্ববর্তী একটি দেশের এজেন্সি দ্বারা চালিত। করোনা আক্রান্ত এই সময়ে যেখানে বাঁচা-মরার প্রশ্ন, সারা পৃথিবী যেখানে স্তব্ধ সেখানে তড়িঘড়ি করে কোন বিভাগে ৫ জন কোন বিভাগে ৫০ জন সদস্যকে দিয়ে আধ খেঁচড়া আকারে কেন দল ঘোষনা দেয়া হল এই প্রশ্ন খুব বেশি অমূলক নয়। বৈরিভাবাপন্ন এই দুই অংশের সন্দেহকে অতিক্রম করাই হবে এবিপি'র মূল চ্যালেঞ্জ।

এই কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এই ভূ-খন্ডে ইসলামের যে ব্যাপ্তি বা শক্তি তাঁর সাথে প্রাপ্তির সামঞ্জস্যতা নেই। এই দেশের পলিটিক্যাল ইসলামের যে বিচিত্রতা বিশেষ করে শাহজালাল, শাহ পরান, খানজাহান, বৃটিশ বিদ্রোহী আন্দোলনে ফকির বিদ্রোহ, ফরাজি আদোলন সহ আরও যা কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে তাঁর কিন্তু সাস্টেইনেবল এচিভমেন্ট নেই। সেন্টিমেন্টাল ইনফ্লুয়েন্স আছে কিন্তু রাষ্ট্রের ভেতরে সিদ্ধান্ত নেয়ার অংশীদারিত্ব তৈরি হয়নি- কারণ ইংরেজ ও কলোনিয়াল শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতি ও আমলানীতিতে তারা অংশ নিতে পারেনি বা ব্যর্থ হয়েছে- যার দায় জামায়াত ও কওমী ঘরনার দলগুলো বহন করে। সময়ের সাথে এডাপ্টিবিলিটি- এইটা ইসলামিস্টদের একটা প্রকট সমস্যা। ফান্ডামেন্টাল ইসলামিক পলিটিক্স এতদিন যাবত সর্বসাধারণে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ওয়াজমাহফিলে বা তাবলীগের আখেরি মোনাজাতে যে ধর্মপ্রান মুসল্লির নামে জনস্রোত দেখা যায় তা আসলে কালচারাল ইসলাম, পলিটিক্যাল ইসলাম না।

তবে বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার নিক্তি পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে।
এই দিক বিবেচনায় এবিপি পার্টির ভবিষ্যৎ ভাল। বিশ্বের নানান দেশে শিক্ষিত কিন্তু ধর্মীয় ফান্ডামেটাল শ্রেণি সংঘবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় আরোহন করছে, রাজনীতিতে প্রভাব রাখছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ধর্মীয় প্রলেপযুক্ত শিক্ষিত, আধুনিক ডান ঘেঁষা একটা রাজনৈতিক দলের শূন্যতা আছে।

এই ভূ-খন্ডে বিগত কয়েক দশক ধরে ক্ষমতার নিক্তি ইসলামকি শক্তির দিকে বেশ কিছুটা নুইয়ে পড়েছে। দেশের বিদ্যমান কওমী ঘরনার ইসলামিক দলগুলো ধর্মীয়ভাবে ফান্ডামেন্টাল হলেও নিজেদের আধুনিক হিসাবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী নিজেদের যতই আধুনিকায়ন করার চেষ্টা করুক না কেন তারা বার বার স্বাধীনতার প্রশ্নে নিজেদের ক্রেডিটিবিলিটি হারিয়েছে। তুর্কি বা মালয়েশিয়া মডেলের পলিটিক্যাল ইসলাম, যাতে সেক্যুলার আবহ থাকবে। সেই হিসেবে তাই এক সম্ভাবনাময় শুন্য সময়ে এবিপি একটা ফাঁকা মাঠ পেতে পারে।

এবিপির বড় শক্তি হল, সংঘবদ্ধতা। এই প্রাকটিস তারা সম্ভবত জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি থেকে শিখেছে। যে কারনে এক বছরের মধ্যই তারা কমবেশি দেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

আশঙ্কার বিষয় হল যে, এই দেশে রাজনৈতিক ইসলাম পছন্দ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তদুপরি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কতৃত্ববাদী শাসন বহাল থাকায় এই ব্যক্তি/গোষ্ঠীর উপর দীর্ঘদিন যাবত নানাবিধ অত্যাচার চলছে। এই ইসলাম পছন্দ ব্যক্তি/গোষ্ঠী ফান্ডামেন্টাল রূপ পরিগ্রহন করে এই নতুন দলে যোগদানের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, এই কিছুদিন আগে আফগানিস্তানে মার্কিনদের হটিয়ে তালেবানরা পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে।

নেতৃত্ব নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। খোলা চোখে যাই দেখা যাক না কেন, এএফএম সোলায়মান চৌধরী এমনকি মজিবুর রহমান মঞ্জুও এদের মূল নেতা নয়। গুঞ্জন রয়েছে, এবিপির মূল নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক কিংবা অন্য কেউ। কিন্তু তিনি/তারা কেন এখনও ফ্রন্ট লাইনে আসছেন না, আদৌ আসবেন কিনা, আসলে কবে আসবেন এই সমস্ত ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। রাজনীতি হল দিনের আলোর মতন পরিষ্কার ব্যাপার, রাতের আঁধারের কর্মকান্ড এই দেশের মানুষ ভালভাবে নেয় না।

পরিশেষাংশে আমার নিজস্ব ধারনা হল, আগামী ২০২৩/২৪ ক্ষমতার পালাবদল কিংবা প্রলম্বিত করার মাহেন্দ্রক্ষনে এবিপি ক্ষমতাসীনদের সাথেই থাকবে। বর্তমান কালের রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু'র মতন ক্ষমতার ভাগীদার হয়েও থাকতে পারে আবার ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মতন ৩০০ আসনে নির্বাচন করেও হতে পারে। এই হিসাবে কেউ কেউ ইতোমধ্য এবিপি'কে কিংস পার্টি হিসাবে অভিহিত করা শুরু করেছেন।

তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের চেতনায় গণতান্ত্রিক, স্পন্দনশীল ও বহুত্ববাদী বাংলাদেশ বির্নিমাণে বিশ্বাসী। তাই মনে করি, টেকসই গণতন্ত্রের জন্য নতুন চিন্তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের সমন্বয় এবং যৌক্তিক বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়। সেই সৌন্দর্যমন্ডিত যাত্রায় এবিপি বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার ও আলোর বিপরীতে নতুন কিছু নাকি সেই পুরনো খেলোয়াড় তা সময়ে উচ্চারিত হবে। আপাতত এবিপিকে সতর্ক স্বাগতম।

লেখক: কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক