করোনা রোগীর রোগ প্রতিরোধে সৃষ্ট অতিরিক্ত কেমোকাইন যেভাবে বিপজ্জনক
গত ৩০ মার্চ ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, চলমান বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ-২ রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেন এর মাধ্যমে মানুষের কোষের রিসেপটর "এইচএসিই ২" রিসেপটর (হিউম্যান এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ রিসেপটর)-তে সংযুক্ত হয়। যখন একজন নভেল করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি/ কাশি/থুতুর মাধ্যমে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস সমৃদ্ধ তরল ড্রপলেট নির্গত করে, সুস্থ ব্যক্তিরা তা শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে বা কোন পৃষ্টের (কাগজ, প্ল্যাস্টিক, স্টেইনলেস ষ্টীল ইত্যাদি) উপরে থাকা ভাইরাস যুক্ত শুস্ক/আদ্র ড্রপলেটগুলো হাতের মাধ্যমে স্পর্শ করে মুখমন্ডলে পরিবাহিত করে। এইভাবে ভাইরাস নাকে ও গলায় প্রবেশ করে। যুক্তরাজ্যের ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইন্সটিউটের বিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রকাশনার প্রিপ্রিন্ট অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস নাকের অভ্যন্তরের আবরণের "এইচএসিই ২" রিসেপটরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেখানে বসবাসের পছন্দনীয় জায়গা খুঁজে পায়।
যুক্তরাজ্যের ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইন্সটিউটের বিজ্ঞানীদের মতে, নাকের অভ্যন্তরের আবরণের কোষগুলো এসিই২ রিসেপটর দ্বারা সমৃদ্ধ। এসিই২ রিসেপটর, কোষগুলোকে সুরক্ষিত না রেখে সংক্রমণ সূচিত করে কারণ ভাইরাস কোষে প্রবেশ করতে এই রিসেপটর কে পথ হিসেবে ব্যবহার করে। ১ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, নভেল সার্স-কোভ-২ ভাইরাস গলার কোষের "এইচএসিই ২" রিসেপটরকেও ব্যবহার করে কোষে প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। ভাইরাস কোষে প্রবেশ করেই, তাদের অসংখ্য কপি তৈরি করে এবং নতুন কোষগুলোকে আক্রমণ করে (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "সায়েন্স")।
যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয় এবং ফুসফুসে ভাইরাস সাংঘাতিক রুপ ধারণ করে (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। ভাইরাস প্রবেশের পর ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দূর্বল করে কোষগুলোকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে। শ্বাসনালির শাখা-প্রশাখা নিয়েই গড়ে ওঠে ফুসফুস। ফুসফুসের শাখা-প্রশাখার সর্বশেষ বিভাজন থেকে তৈরি হয় অসংখ্য ক্ষুদ্র বায়ুথলিগুলো, যাকে এলভিওলি বলা হয়। বায়ুথলিগুলোও "এসিই২" দ্বারা সমৃদ্ধ।
বায়ুথলি পাতলা আবরণ দ্বারা আবৃত এবং প্রতিটি বায়ুথলি সরু রক্তের কৈশিক নালিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। বায়ুথলি ও রক্তের কৈশিক নালিকার গাত্র এত পাতলা যে এর ভেতর দিয়ে গ্যাসীয় আদান-প্রদান ঘটে। সাধারণত, অক্সিজেন নাসাপথ দিয়ে বায়ুথলিগুলোর মাধ্যমে রক্তের কৈশিক নালিকায় যায়; তারপর অক্সিজেন সমস্ত দেহে পৌঁছায়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের সাথে লড়াই করার ফলে, অক্সিজেন পরিবহনে বাধাগ্রস্থ হয়। ফুসফুস করোনাভাইরাস দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সময় দেহের শ্বেত রক্ত কণিকা, কেমোকাইন (Chemokine) নামক "সিগন্যালিক প্রোটিনকে" উন্মুক্ত করে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মোলিকুলার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, কেমোকাইন হচ্ছে, ছোট প্রোটিন (ভর ৮-১০ কিলোডালটনস) যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ও ক্ষতের নিরাময়ে (রক্ত জমাট বাধা সহ নতুন কোষ তৈরিতে) বিভিন্ন ধরণের কোষ থেকে নিঃসৃত হয়।
নতুন কেমোকাইন আরোও অধিক পরিমানে রোগ প্রতিরোধী কোষকে জড়ো করে যা ভাইরাস আক্রান্ত ফুসফুসের কোষগুলোকে মেরে ফেলে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "সায়েন্স")। একারণে সৃষ্ট তরল ও মৃত কোষগুলি পুঁজে পরিণত হয়। এটি কোভিড-১৯ রোগের নিউমোনিয়া (ফুসফুসে প্রদাহ)। মাঝে মাঝে, আক্রান্তদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া হঠাৎ করেই অধিকতর খারাপ পর্যায়ে যায়, যাকে বলা হয় অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম (এআরডিএস)। নিউমোনিয়ার মারাত্মক পর্যায়ে ভাইরাসের তীব্র সংক্রমণের কারণে ফুসফুসের বায়ুথলিগুলো শ্লেষ্মা, রক্তের শ্বেত কণিকা, তরল পদার্থ ও ফুসফুসের ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষের রাবিশ দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত কমে যায় এবং চরম শ্বাসকষ্ট হয়। এই ধরণের ক্রিটিকাল সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য রোগীকে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যান্ত্রিক ভেন্টিলেটর দেওয়া হয়।
সম্প্রতি, ডাচ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন ১৮৪ জন নিশ্চিত নিউমোনিয়াসহ কোভিড-১৯ রোগীর মধ্যে ৩৮% রোগীর রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার (thrombosis) রিপোর্ট পাওয়া গেছে এবং চিকিৎসকগণ সকল কোভিড রোগীকে রক্ত জমাট আক্রমণ এড়াইবার জন্য চিকিৎসা হিসেবে উচ্চমাত্রার ড্রাগ (high-prophylactic doses) সুপারিশ করেছেন (তথ্যসূত্রঃ ১০ এপ্রিল ২০২০ তারিখের 'থ্রম্বোসিস রিসার্চ' জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ)। কোভিড-১৯ রোগীর মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে দেহের অন্য জায়গার রক্ত জমাটগুলো ফুসফুসের মূল ধমনিগুলোতে (রক্তনালী) জমা হয়ে ধমনিগুলো ব্লক করে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "সায়েন্স")। ফুসফুসের মূল ধমনিগুলোতে রক্ত জমাটগুলো জমা হয়ে ধমনিগুলোর ব্লককে পালমোনারি এমবোলিজম বলা হয়; যার প্রধান লক্ষণ তীব্র শ্বাসকষ্ট (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েব সাইট "হেলথলাইন")।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারের কার্ডিওভাসকুলার মেডিসিন ফেলো বেহনুড বিকডেলি বলেন, অনেক কোভিড-১৯ রোগীর দেহে উচ্চ মাত্রায় ব্লাড ক্লটের (রক্ত জমাট) উপজাত ডি-ডাইমার (D-dimer) পাওয়া গেছে। বিকডেলি আরও বলেন, ব্লাড ক্লটগুলোর কারণে কোভিড-১৯ রোগ মারাত্মক ও প্রাণহানির প্রধান কারণ হচ্ছে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের চিকিৎসা বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "সায়েন্স")। স্পেনের হাসপাতালে অনেক কোভিড-১৯ রোগীর দেহে জমাট রক্ত (ব্লাড ক্লট) পাওয়া গেছে ((তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ সাইট এবিসি সেভেন)।
ফুসফুসে নভেল করোনাভাইরাস আক্রমণের পর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জীবাণুকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ফুসফুস করোনাভাইরাস দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সময় লড়াইয়ের জন্য দেহের শ্বেত রক্ত কণিকা "কেমোকাইন" নামক সিগন্যালিং প্রোটিনের সংখ্যা বাড়াতে থাকে (তথ্যসূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স")। কেমোকাইন আরোও অধিক পরিমানে রোগ প্রতিরোধী কোষকে জড়ো করে, যা ভাইরাস আক্রান্ত ফুসফুসের কোষগুলোকে মেরে ফেলে। ফলে ফুসফুসের আরো ক্ষতি হয়।
নিউইয়র্কের আপস্টেট মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও ক্রাউস হেলথের ফুসফুস জটিল রোগ বিশেষজ্ঞ ড ভিরেন কাউর বলেন, কোভিড-১৯ রোগীর ফুসফুসে চাপ ও মারাত্মক প্রদাহের সৃষ্টি করে, যা রোগীর দেহে রক্ত জমাটে (ব্লাড ক্লট) প্ররোচিত করে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম এবিসি নিউজ)।
উল্লেখ্য, কেমোকাইনিন মানবদেহে রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন ছাড়াও, ক্ষতের সময় হেমোস্ট্যাসিস (Hemostasis) পর্যায়ে রক্ত জমাটে (ব্লাড ক্লট) গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে (তথ্য সূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ মোলিকুলার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ)। কোভিড-১৯ রোগীর ক্ষেত্রে ব্লাডক্লটগুলো প্রাণহানির কারণ হচ্ছে কারণ ফুসফুসের রক্তনালী ও হৃদপিন্ডে ঘটছে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক ওয়েবসাইট "সায়েন্স" ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ সাইট এবিসি সেভেন)। কেমোকাইন প্রোটিন এই ধরণের রক্তজমাটে ভূমিকা রাখছে।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়