লকডাউন শিথিলের সময় কি হয়েছে?
বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকে একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে গেছে তা হলো কোনটি আগে জীবন না জীবিকা? উত্তর বেশ কঠিন।
অনেকে বলছেন, মানুষ বাঁচলেই অর্থনীতি পুর্নগঠন করা যাবে। আবার, অনেকে ভিন্নমত দিচ্ছেন। তবে, বিশ্ব নেতারা করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে মানুষ বাঁচানোর পক্ষে রায় দিচ্ছেন। বিশ্ব নেতাদের এই রায় নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
মানুষকে বাঁচানোর জন্য সারাবিশ্বব্যাপী লকডাউন অবস্থা বিরাজ করছে। লকডাউনের কারণে স্থবির হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির চাকা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরার কারণে সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব এক অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ হবে ৯ লাখ কোটি ডলার। যা কি না জাপান ও জার্মানির অর্থনীতির আকারের সমান। দিন যত গড়াচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণও ততই বাড়ছে। ক্ষতির পরিমাণ হ্রাসের জন্য এবং জনগণের দাবির মুখে অনেক দেশেই এখন লকডাউন শিথিলের কথা ভাবছে।
ইতিমধ্যে নিউজিল্যান্ড, ইতালি, স্পেন, জার্মানির মত দেশগুলো লকডাউন শিথিল করছে। পুরোপুরি লকডাউন উঠিয়ে নেয়া হয়েছে করোনার প্রথম সংক্রমণস্হল চীনে। লকডাউন প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে সশস্ত্র বিক্ষোভের মত ঘটনাও ঘটেছে।
মূলত, মানুষ আর চাইছে না ঘরবন্দী থাকতে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর হার নিম্নগামী না হওয়া পর্যন্ত লকডাউন প্রত্যাহার করা হতে পারে বিপদজনক সিদ্ধান্ত। যেমনটি জার্মানিতে দেখা যাচ্ছে। লকডাউন শিথিলের পর জার্মানীতে নতুন করে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে।
তাহলে এখন উপায় কী? লকডাউন অবস্থা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হলে নিতে হবে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ। প্রথমত, ব্যাপকহারে করোনার পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে, যারা করোনা আক্রান্ত নন তারা ফিরতে পারবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজে এবং যারা আক্রান্ত তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
এই পরীক্ষার জন্য দেশগুলোর প্রয়োজন হবে পর্যাপ্ত পরিমাণ টেস্ট কিট, সুরক্ষা সামগ্রী এবং ভেন্টিলেটরের। দ্বিতীয়ত, গড়ে তুলতে হবে ফলপ্রসূ রোগ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে, আমরা উদাহারণ হিসাবে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার কথা বলতে পারি।
তারা অনলাইনের মাধ্যমে রোগ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করে সফলতার মুখ দেখছে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রোগীর গতিবিধি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যার কারণে, কার্যকরভাবে কমানো গেছে সংক্রমণের হার।
তৃতীয়ত, কোভিড-১৯ থেকে বেরিয়ে আসার এবং লকডাউন উঠিয়ে নেয়ার কার্যকর পন্থা হতে পারে করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পর তা বিশ্বের সকলের জন্য সমভাবে বন্টনকে সুনিশ্চিত করা। যেহেতু, ভ্যাকসিন আবিষ্কার প্রক্রিয়া এখনও চলমান। এজন্য করোনার ব্যাপক পরীক্ষা ও রোগীর গতিবিধি নজরদারির সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে লকডাউন শিথিল করা যেতে পারে।
এই ব্যাপক করোনা পরীক্ষা ও রোগী নজরদারি ব্যবস্থা কার্যকরভাবে সম্পন্ন করা সকল দেশের জন্য সহজসাধ্য নয়। এ কারণে, উন্নত দেশগুলোর উচিত হবে অনুন্নত দেশগুলোকে চিকিৎসা সামগ্রী এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা করা। কিন্তু, অতীব পরিতাপের বিষয় বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়াগুলো সফলভাবে সম্পন্ন না করেই পোশাক শিল্প কারখানা খোলাসহ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
যদিও পোশাক শিল্প কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা দিয়েছে। তথাপি কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। বাংলাদেশের এখন উচিত হবে, পরীক্ষার হার আরো বাড়িয়ে দেওয়া এবং অতি সংক্রমিত এলাকাগুলোকে আলাদা করে ফেলা। কম সংক্রমিত এলাকাগুলোতে এবং সংক্রমণহীন এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চালু করা।
এক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থাও করতে হবে। নতুবা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ নিতে পারে। কেননা অতি আক্রান্ত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, ৪০ থেকে ৬০তম দিনের মধ্যবর্তী সময়ে এসব দেশে সংক্রমণ বেশি হয়েছে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা চর্তুথ ধাপে তাই অধিক সর্তকতার সময়।
আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও সমগ্র দেশকে লাল, কমলা, সবুজ এই তিনভাগে ভাগ করে লকডাউন শিথিলের চেষ্টা করা হচ্ছে। এজন্য আমাদের উচিত হবে পরীক্ষা হার বাড়ানোয় আরো বেশি নজর দেওয়া এবং কিছু সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা। তাছাড়া এই দুঃসময়ে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদেরকে আলোর পথ দেখাবে।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা