০২ মে ২০২০, ১১:২৪

পিসিআর এ কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েও আক্রান্ত না হওয়া

  © টিডিসি ফটো

রিয়েল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন-পলিমারেজ চেইন রিয়েকশন (real time RT-PCR) হচ্ছে, করোনাভাইরাস সনাক্তের ও পরীক্ষণের জন্য সবচেয়ে নির্ভুল ল্যাবরেটরি পদ্ধতিগুলোর অন্যতম প্রধান (তথ্য সূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল পরমাণু শক্তি এজেন্সি)। কোভিড-১৯ পজিটিভ কি না, তা নির্ণয়ের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে, রিয়েল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন (পিসিআর)। এই পদ্ধতি (রিয়েল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন-পিসিআর)- পারমাণবিক-উদ্ভূত (nuclear-derived) পদ্ধতি, যা ভাইরাসসহ যে কোন প্যাথোজেনের জেনেটিক বস্তুসমূহ নিখুঁতভাবে শনাক্ত করে।

ভাইরাস হচ্ছে, আবরণ বিশিষ্ট জেনেটিক বস্তু/উপাদানের মাইক্রোস্কপিক প্যাকেজ। জেনেটিক বস্তু/উপাদানটি ডিএনএ বা আরএনএ (DNA or RNA) হতে পারে। এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA ভাইরাস পরিবার যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (নাক, গলা, ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। RNA অর্থ Ribonucleic acid (রাইবোনিউক্লিক এসিড)।

ডিএনএ (DNA) ও আরএনএ (RNA) উভয়েই জীবকোষের জেনেটিক বস্তু/উপাদান। ডিএনএ হচ্ছে- দুইটি স্ট্র্যান্ড বিশিষ্ট অণু (two-strand molecule) এবং তা জীবের গঠনের ও বিকাশের সকল ও অসংখ্য জেনেটিক কোড (ব্লু প্রিন্ট) ধারণ করে। ডিএনএ তে ধারণকৃত বিভিন্ন জেনেটিক কোড আরএনএ বহন করার মাধ্যমে জীবদেহে বিভিন্ন প্রোটিন তৈরি করে, যা জীবদেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশের জন্য দায়ী। ডিএনএ অণুর বিভিন্ন অংশে সুনির্দিস্ট প্রোটিন তৈরির সুনির্দিস্ট জেনেটিক কোড রয়েছে; যা ডিএনএর ক্রমবিন্যাসের ভিন্নতার সাথে সংশ্লিষ্ট। অন্যদিকে, আরএনএ হচ্ছে- একটি স্ট্র্যান্ড বিশিষ্ট অণু (one-strand molecule), যা অল্প কিছু জেনেটিক কোড বহন করে। করোনাভাইরাস (SARS-Cov2) শুধুমাত্র আরএনএ ধারণ করে (ডিএনএ নয়)।

নভেল করোনাভাইরাসের আরএনএ সামান্য জেনেটিক কোড বহন করার কারণে তারা টিকে থাকার জন্য মানুষ বা অন্য প্রাণীর কোষের অঙ্গাণুগুলোর উপর সম্পূর্নভাবে নির্ভরশীল। নভেল করোনাভাইরাস মানুষের কোষে প্রবেশের পরে নিজেদের আরএনএ এর অল্প জেনেটিক কোডের মাধ্যমে মানব দেহ কোষের অঙ্গাণুগুলো হাইজ্যাক করে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং নতুন প্রোগ্রাম সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের কোষকে "ভাইরাস সৃষ্টির কারখানায়" পরিণত করে (তথ্য সূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল পরমাণু শক্তি এজেন্সি)।

যেহেতু নভেল করোনাভাইরাস (SARS-Cov2) একটি আরএনএ ভাইরাস; তার জেনেটিক বস্তু আরএনএ (RNA) দিয়ে তৈরি; ডিএনএ (DNA) নয়। এই জন্য কোনো মানুষের দেহে এই ভাইরাসটি আছে কি না, তা সনাক্ত ও পরীক্ষণের জন্য পরীক্ষাগারে মানুষটির নাক বা গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে প্রোটিন ও ফ্যাট/লিপিড আলাদা করে সেই নমুনা থেকে শুধুমাত্র আরএনএ সংগ্রহ করা হয়। যদি নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থাকে তাহলে অবশ্যই ভাইরাসটির আরএনএ (RNA) পাওয়া যাবে। এরপর রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পিসিআর (RT-PCR) নামক পদ্ধতির মাধ্যমে আরএনএ থেকে এর একটি ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরি করে সেই ডিএনএকে বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়।

নভেল করোনাভাইরাসের ডিএনএ না থাকলেও, পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে এর আরএনএ থেকে ডিএনএ-স্বরূপ একটি প্রতিলিপি তৈরি করা যায়। গবেষকগণ আরএনএ থেকে ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরি করেন কারণ রিয়েল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পিসিআর পদ্ধতির মাধ্যমে সনাক্ত ও পরীক্ষণের সুবিধার জন্য শুধুমাত্র ডিএনএ (DNA) এর কপি করে সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় (আরএনএ এর ক্ষেত্রে সম্ভবপর নহে)।

মানুষের দেহের ভেতরে ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরির প্রক্রিয়াটিকে বলে ট্রান্সক্রিপশন এবং এর বিপরীত অর্থাৎ আরএনএ থেকে ডিএনএ তৈরির প্রক্রিয়াটি হলো রিভার্স (বিপরীত) ট্রান্সক্রিপশন। এই থেকে RT-PCR নামের প্রথম অংশের উৎপত্তি, যা রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ নামক একটি এনজাইমের উপস্থিতিতে হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় অংশ, অর্থাৎ পলিমারেজ চেইন রিয়েকশন (PCR), পলিমারেজ নামের আরেকটি এনজাইমের দ্বারা সংঘটিত হয়। পলিমারেজ এনজাইম -- ডিএনএ থেকে অসংখ্য ডিএনএ তৈরি করতে পারে। মানুষ ও অন্যান্ন প্রাণীর দেহের ভেতরে পলিমারেজ এনজাইম প্রতিনিয়ত ডিএনএ থেকে ডিএনএর প্রতিলিপি তৈরি করে চলছে। পলিমারেজ এনজাইম দিয়ে পরীক্ষাগারে পিসিআর মেশিনের সাহায্যে একটি ডিএনএ থেকে ডিএনএ অণুর সংখ্যা লক্ষ-কোটি গুণ বাড়ানো সম্ভব। করোনাভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হতে অসংখ্য ভাইরাল ডিএনএ প্রয়োজন (তথ্য সূত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল পরমাণু শক্তি এজেন্সি)।

ইতোমধ্যে দক্ষিন কোরিয়ায় ২৬০ জনের অধিক কোভিড-১৯ রোগ থেকে আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তিগণের পজিটিভ করোনাভাইরাস টেস্ট পাওয়ায় শঙ্কার কারণ ছিল যে, নভেল করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে পুনঃসক্রিয় হতে বা একাধিক বার সংক্রমণ ঘটাতে পারে। কিন্তু সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ এখন বলছেন -- এমনটি ঘটার সম্ভাবনা নেই।

৩০ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে এক নিউজ ব্রিফিংয়ে সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালের ডাক্তার ড. ওহ মিয়ং-ডন বলেন, বরং, যে পলিমারেজ চেইন রিয়েকশন (পিসিআর) পদ্ধতিটি করোনাভাইরাস সনাক্তে ব্যবহৃত হয়, তা সংক্রামক (সক্রিয়) ভাইরাস এবং "মৃত" ("dead") ভাইরাসের ছোট টুকরাগুলোর (fragments) অর্থাৎ উভয়ের জেনেটিক বস্তুর (আরএনএ/ডিএনএ) মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। "মৃত" ("dead") ভাইরাসের ছোট টুকরাগুলো আরোগ্য লাভের পর মানুষের দেহে অনেক সময়কাল থাকে (তথ্য সূত্রঃ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম "দ্য কোরিয়া হেরাল্ড" ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির বায়োলজি এন্ড নিউরাল সায়েন্স এর প্রফেসর ক্যারল রেইস বলেন, যদিও কেউ করোনাভাইরাস থেকে আরোগ্য লাভ করেন এবং সংক্রামক ভাইরাস না থাকলেও, দেহে থেকে যাওয়া ভাইরাল আরএনএ এর ছোট নিস্ক্রিয় (inactive) টুকরাগুলো পজিটিভ টেস্ট দেয়। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসকে পরাজিত করলে, মৃত কোষগুলির সমস্ত খন্ড বিখন্ড আবর্জনা (জেনেটিক বস্তু সহ) দেহ থেকে পরিস্কার হতে সময় প্রয়োজন (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")।

আরোগ্য লাভের পরপরই দেহে সংক্রামক (সক্রিয়) ভাইরাসের উপস্থিতি বা করোনাভাইরাস দ্বারা পুনঃসংক্রমণ যাচাইয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন টেস্টের প্রয়োজন হবে; রিয়েল টাইম RT-PCR পদ্ধতিতে তা নির্ধারন সম্ভবপর নয়। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ক্যারল রেইস বলেন, আরোগ্যলাভকারীর দেহে সংক্রামক ভাইরাস (সক্রিয়) এর উপস্থিতি নির্ধারনের জন্য -- ল্যাব টেকনিশিয়ানদের দ্বারা নমুনা কালচার করে --- ভাইরাসের বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা জানা সম্ভব হবে। দ্য কোরিয়া সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিন কোরিয়ার যে সকল আরোগ্যলাভকারীর দেহে পুনঃপরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া গিয়েছিল, তাঁদের দ্বারা ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা নাই (তথ্য সূত্রঃ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম "দ্য কোরিয়া হেরাল্ড")।

বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, SARS-CoV-1, MERS-CoV ও কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV-2 এবং মানুষের জন্য ক্ষতিকর অন্য দুইটি করোনাভাইরাস HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 বিটা করোনাভাইরাস জেনাসের অন্তর্ভুক্ত। HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 করোনাভাইরাস শ্বসনতন্ত্রের উচ্চাংশে (নাক, কান, গলা) মৃদু থেকে মাঝারি সংক্রমণ করে। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, মানুষের জন্য ক্ষতিকর সাতটি করোনাভাইরাসের মধ্যে তিনটি করোনাভাইরাস, SARS-CoV- 1, MERS-CoV ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-COV-2 মানুষের মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

যখন বহিরাগত আক্রমণকারী যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করে, দেহের লিম্ফোসাইটস নামক ইমিউন কোষগুলো এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সাড়া দেয়। এন্টিবডি হচ্ছে প্রোটিন। এই এন্টিবডিগুলো বহিরাগত আক্রমণকারীর (ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) সাথে লড়াই করে এবং দেহকে অতিরিক্ত সংক্রমণের থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। বিটা করোনাভাইরাস, HCoV-OC43 ও HCoV-HKU1 এর সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট নির্দিষ্ট এন্ডিবডির ফলে গঠিত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা চল্লিশ সপ্তাহ টেকসই থাকে (তথ্য সূত্রঃ এপিডিমিয়োলজি এন্ড ইনফেকশন জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ); অন্যদিকে, ইমারজিং ইংফেক্সাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালে সংগঠিত মহামারির জন্য দায়ী করোনাভাইরাস SARS-CoV-1 এর সংক্রমণের ফলে মানবদেহে গঠিত নির্দিষ্ট এন্ডিবডি উক্ত ভাইরাসের ক্ষেত্রে গড়ে দুই বছর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রেখেছিল।

১৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, ২০২৫ সাল পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগের প্রাদুর্ভাব চূড়ান্তভাবে (crucially) নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের কারণে মানবদেহে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থিতিকালের উপর। ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধ ও হ্রাসে ২০২২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত বা সবিরাম সামাজিক শিষ্টাচার (শারীরিক দূরত্ব) অপরিহার্য হতে পারে (তথ্য সূত্রঃ ১৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ)। অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, অর্থাৎ ব্যাপক ডায়াগনস্টিক টেস্ট, সংকটপূর্ণ তত্ত্ববধান সামর্থ্য বৃদ্ধি, কার্যকর থেরাপিউটিক (ভ্যাকসিন/ড্রাগ আবিস্কার) ইত্যাদি সবিরাম সামাজিক শিষ্টাচার (শারীরিক দূরত্ব) কে ফলপ্রসু করবে এবং অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অগ্রসর করবে।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়