০১ মে ২০২০, ০২:২১

বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে রহস্যময় ভাইরাস করোনার নতুন লক্ষণ?

  © টিডিসি ফটো

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির প্রধান প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে, জ্বর, ক্লান্তি ও খুসখুসে শুষ্ক কাশি। কোভিড-১৯ আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্দি, গলা ব্যথা, নাক কনজেশন, তীব্র বা মাঝারি শ্বাস কষ্ট এবং শরীরে ব্যথা বা ডায়রিয়া দেখা যায়। কারও স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়ার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ রোগের সকল লক্ষণ খুঁজছেন।

কোভিড-১৯ রোগীদের পায়ের আঙ্গুলে তুষারস্পর্শে প্রদাহ বা ক্ষতের মত দেখতে ফুসকুড়ি (ফ্রস্টবাইট্‌/frostbite-like rash) নতুন লক্ষণ হতে পারে মনে করছেন বিশ্বের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞগণ। ২৯ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম "দ্য ওয়াশিংটন পোষ্ট" প্রদত্ত তথ্য মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ড. এস্থার ফ্রিম্যান জানান, অনেক কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর পায়ের আঙ্গুলে ফ্রস্টবাইট্ এর মত ফুসকুড়ি (প্রদাহ বা ক্ষত) দেখা গিয়েছে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এই ফুসকুড়ি হালকা লালচে থেকে রক্তবেগুনী হয়ে জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পায়ের আঙ্গুলে ফ্রস্টবাইটের মত ফুসকুড়িকে- "পারনিও" (pernio) বা "চিলিব্লেন্স" (chilblains) বলা হয়-- যা সচরাচর প্রচন্ড ঠাণ্ডা বা বরফের প্রভাবে হয়ে থাকে (তথ্য সূত্রঃ ২৯ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম "দ্য ওয়াশিংটন পোষ্ট")। কিন্তু কোভিড-১৯ আক্রান্ত অনেক রোগীদের পায়ের আঙ্গুলে "বসন্তকালে" (in spring) ফ্রস্টবাইটের মত ফুসকুড়ি দেখা যাচ্ছে।

নভেল করোনাভাইরাস ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে আবির্ভুত হওয়ার পর এ ভাইরাস প্রধানত ফুসফুস আক্রান্ত করে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এ ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে কিডনি, হার্ট ও দেহের অন্যান্ন গুরুত্বপূর্ন অঙ্গগুলোর মারাত্মক ক্ষতের রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে (তথ্য সূত্রঃ ২৯ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম "দ্য ওয়াশিংটন পোষ্ট")। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞগণেরা মনে করছেন-- কিছু কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে পায়ের আঙ্গুলে ফ্রস্টবাইটের মত ফুসকুড়ি প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।

চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ড. এস্থার ফ্রিম্যান "দ্য ওয়াশিংটন পোষ্ট" কে বলেন, এই অদ্ভুত “covid toes” ফুসকুড়ি  শুধুমাত্র কম বয়সী কোভিড-১৯ রোগীদের (শিশু ও যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর) ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে। ড. এস্থার ফ্রিম্যান যুক্তরাষ্ট্রের অন্য খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম "ইউএসএ টুডে" কে বলেন, পায়ের আঙ্গুলের রক্তনালীতে রক্ত জমাটের কারণে এ ধরণের ফুসকুড়ি হতে পারে বা রক্তনালীর দেওয়ালের প্রদাহ অর্থাৎ "ভ্যাসকুলাইটিস" (vasculitis) হতে পারে। স্পেনের হাসপাতালে অনেক কোভিড-১৯ রোগীর দেহে জমাট রক্ত (ব্লাড ক্লট) পাওয়া গেছে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ সাইট এবিসি সেভেন)।

ফ্রান্স ডার্মাটোলজি গ্রুপ এ বছর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে পায়ের আঙ্গুলে এই ধরণের লক্ষণ প্রকাশ্যে আনেন (তথ্য সূত্রঃ ২৯ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা সংবাদ মাধ্যম "দ্য ওয়াশিংটন পোষ্ট")। এপ্রিল এর ৩য় সপ্তাহে জার্নাল অফ দ্য আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজির প্রবন্ধে গবেষকগণ বেলজিয়ামে ২৩ বছর বয়স্ক কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত স্টুডেন্টের পায়ের আঙ্গুলে একই ধরণের ফুসকুড়ির বর্ননা দিয়েছেন। তবে, এই ধরণের অদ্ভুত ফুসকুড়ি (rash) কোভিড-১৯ রোগের কারণে কিনা, তা নিশ্চিত হতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের ৫৫টি দেশের ৩,৬০০ জন করোনা-রোগীর দেহ থেকে ভাইরাস-নমুনার আরএনএ সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা করেন ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স এর দুইজন গবেষক নিধান বিশ্বাস ও পার্থ মজুমদার (তথ্য সূত্রঃ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। তাঁদের গবেষণায় জানা গেছে, চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সংক্রমণ ঘটায় ‘ও’ (‘O’) টাইপ নভেল করোনাভাইরাস, সার্স-কোভ-২ (SARS-COV-2)। পরবর্তী চার মাসে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকভাবে মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটেছে SARS-COV-2 ভাইরাসটির গঠনে।

ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স এর গবেষণায়, ‘ও’ (‘O’) টাইপ করোনাভাইরাস থেকে জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত A2, A2a, A3, B, B1-সহ মোট দশ ধরণের করোনাভাইরাস গঠিত হয়েছে (তথ্য সূত্রঃ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। বিশ্বের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে রহস্যময় ভাইরাস হচ্ছে-- কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাস। জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে গঠিত নতুন ধরণের সার্স-কোভ-২ হয়ত নতুন লক্ষণ প্রকাশ করছে।

সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে সময়ের সাথে সাথে রূপ বদলিয়ে আরোও বেশী সংক্রমণ ক্ষমতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বিশ্বে কয়েক শত গবেষণা গ্রুপ কার্যকর ভ্যাকসিন ও এন্টিভাইরাল ড্রাগস আবিষ্কারে মরিয়া (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েব সাইট "সায়েন্স" এবং 'লাইভ সায়েন্স')।

বিশ্বের স্বাস্থ্য গবেষকগণের মতে, নতুন চিকিৎসা আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর নিন্মোক্ত সুপারিশগুলো সকলের মেনে চলা অত্যাবশ্যক।
১. সাবান ও পানি দিয়ে ঘনঘন প্রতিবার অন্তত ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া।
২. হাত পরিস্কার না করে মুখ, চোখ ও নাক স্পর্শ না করা।
৩. আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা।
৪. বাড়ির বাহিরে মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করে শ্বসন স্বাস্থ্যবিধি পালন।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়