লকডাউন বনাম হার্ড ইমিউনিটির তত্ত্ব, কোন পথে বাংলাদেশ?
গোটা বিশ্ব আজ করোনার থাবায় অচল। বিশ্বের এ অচলাবস্থা কবে কাটবে তা অনিশ্চিত। ফলে অর্থনীতির চাকা সচল করতে কি করা যায় আবার এ মহামারির হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সেই পথ খুঁজতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে বিশ্ব। করোনার জেরে লকডাউন বহু দেশ, মানুষের সাধারণ জীবনযাপন আজ বিপন্ন। গবেষকদের ধারনায় করোনা আক্রমণ করছে বেশি তাদেরকেই যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেম কম। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা দুইটি দলে বিভক্ত। যেখানে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দুই বৈজ্ঞানিক দল দুটি আলাদা অস্ত্রের কথা বলছে।
একদল বলে বাড়িতে থাকুন। অর্থাৎ, লকডাউনের উপর জোর দিচ্ছেন। অন্য দল বলে বাড়ি থেকে বের হও। বাড়িতে থাকলে পুরো বিশ্বের অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। তবে জনগন বাড়ি থেকে বের হলেই সংক্রমণটি তাদের ধরে ফেলার আশঙ্কা দূর করা যাচ্ছে না। সুতরাং এর থেকে লুকিয়ে থাকার চেয়ে মুখোমুখি হোন। এতে লোকেরা যত বেশি সংক্রামিত হবে, মানবদেহ এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্য এটি আরও শক্তি তৈরি করবে। একে বলে হার্ড ইমিউনিটি। অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বকে করোনা ভাইরাস এড়াতে এই হার্ড ইমিউনিটি গ্রহণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
যাতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা যায়। এটি আশ্চর্যজনক হলেও যদি চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রাচীনতম পদ্ধতি অনুসারে ভাবা যায় তাহলে এটি সত্য। এর অর্থ হল ভবিষ্যতে মানুষকে রক্ষা করতে জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশকে ভাইরাসে সংক্রমিত হতে দেওয়া উচিত। এটি তাদের দেহের মধ্যে সংক্রমণের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে অনাক্রম্যতা তৈরি করবে। এর ফলে শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে। যা তাদের দেহ থেকে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার চেষ্টা করা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা করোনার ভ্যাকসিন তৈরির এই দ্রুততম উপায়টি খুঁজে পেয়েছেন। ভ্যাকসিন তৈরি করা যতক্ষণ না সম্ভব হচ্ছে ততক্ষণ এই পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউন পদ্ধতিকে বেচে নিলেও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতি গ্রহন করতে দেখা গেছে সুইডেন, নিউজিল্যান্ডসহ প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যকে।
তবে আমাদের দেশের মত ঘনবসতি, জনবহুল দেশে এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর হবে তা কিন্তু অনুমেয়। যদি অধিকহারে সংক্রমণ ঘটে তাহলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা কি সম্ভব হবে সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কল-কারখানা সীমিত আকারে খুলে দেওয়া, আবার ঢাকার রেস্তোরাঁ খুলে দেওয়া, ঢীলেঢালা লকডাউন এসব কি ইঙ্গিত দেয় আমরাও কি হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতির দিকেই হাটছি? করোনা মহামারি শুরুর পর প্রায় ৫০০ জনের অধিক গবেষক লিখিত আকারে জানিয়েছিল এই হার্ড ইমিউনিটির পথ কতটা ভয়ষ্কর হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে মোট জনসংখ্যার ৬০-৭০% মানুষকে আক্রান্ত হবার পর সুস্থ হতে হবে। ফলে এটা সহজে অনুমেয় এই পথটি সহজ কোন পথ নয়। বিভিন্ন দেশ এ মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায় বেচে নিচ্ছে। ফলে তাদের সিদ্ধান্ত গুলোও আলাদা। উদাহরণস্বরুপ যদি উন্নত রাষ্ট্র সুইডেন, কানাডা কিংবা নিউজল্যান্ডের কথা বলি তার সাথে বাংলাদেশের অবস্থাকে মেলানো কোন ভাবেই যুক্তিসংগত হবে না। কেননা, আমরা যদি সুইডেনের জনসংখ্যা ও সেখানে বসবাসের ঘনত্ব দেখি তাহলে দেখা যায়, সুইডেনের মোট জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি। আর প্রতি বর্গকিলোমিটারে সেখানে মাত্র ২৫ জন লোক বসবাস করে।
পক্ষান্তরে, আমাদের দেশে প্রায় ১৭ কোটির অধিক লোক বসবাস করে। যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে হাজারের অধিক। ফলে সুইডেন লকডাউন শিথিল করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ করে চলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে এটি করা অসম্ভবপ্রায়। এছাড়া উন্নত রাষ্ট্রকে হুবুহু অনুসরণ করাও যুক্তিগত নয়। ফলে সরকারের উচিত হবে নিজেদের সম্পদ ও সামর্থ্য অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহন করা।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।