২৯ এপ্রিল ২০২০, ১০:৩৫

নিজেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে করোনা

  © টিডিসি ফটো

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ গবেষণা অনুযায়ী, চারটি করোনাভাইরাস, 229E, OC43, NL63 এবং HKU1, মানুষের জন্য অল্প ক্ষতির কারণ হলেও, অন্য তিনটি করোনাভাইরাস, SARS-CoV (severe acute respiratory syndrome coronavirus), MERS-CoV (Middle East respiratory syndrome coronavirus) ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-COV-2 (severe acute respiratory syndrome coronavirus-2) মানুষের মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হিসেবে বিবেচিত।

ভাইরাস হচ্ছে- আবরণ বিশিষ্ট জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালের মাইক্রোস্কপিক প্যাকেজ। জেনেটিক ম্যাটেরিয়ালটি ডিএনএ বা আরএনএ (DNA or RNA) যে কোন একটি হতে পারে। এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA ভাইরাস পরিবার যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (নাক, গলা, ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। RNA অর্থ Ribonucleic acid (রাইবোনিউক্লিক এসিড)।

ডিএনএ হচ্ছে- দুইটি স্ট্র্যান্ড বিশিষ্ট অণু (two-strand molecule) এবং তা জীবের গঠনের ও উন্নয়নের অসংখ্য জেনেটিক কোড বা ব্লু প্রিন্ট ধারণ করে। অন্যদিকে, আরএনএ হচ্ছে- একটি স্ট্র্যান্ড বিশিষ্ট অণু (one-strand molecule), যা অল্প কিছু জেনেটিক কোড বহন করে।  অল্প কিছু জেনেটিক কোড থাকার কারণে করোনাভাইরাসের মত আরএনএ ভাইরাসগুলো টিকে থাকার জন্য সম্পুর্নভাবে মানব দেহ কোষের উপর নির্ভরশীল। করোনাভাইরাস মানব দেহকোষে প্রবেশের পরে দেহ কোষের অঙ্গাণুগুলো হাইজ্যাক করে নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং নতুন প্রোগ্রাম সৃষ্টির মাধ্যমে মানবদেহ কোষগুলোকে ভাইরাস তৈরির কারখানা করে ফেলে।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV ও ২০১৯-২০২০ সালের মহামারি কোভিড-১৯ এর ভাইরাস SARS-COV-2 এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ জেনেটিক সম্পর্ক আছে। উভয় ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল বাদুড়। করোনাভাইরাসের বাহিরের আবরণে স্পাইক প্রোটিনগুলো একত্রিত হয়ে মুকুটের মত ট্রাইমারস গঠন করে।

৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, সার্স কোর্ভ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের গঠন জেনেটিক্যালি ‘mutations’ (মিউটেশন) এর মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে নতুন স্পাইক প্রোটিনের গঠন হওয়ার ফলে সৃষ্ট ভাইরাস সার্স-কোভ-২ (কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস) মানুষের কোষকে পূর্বের চেয়ে অধিকতর আক্রান্ত করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ‘Mutation’ অর্থ কোষের জিনের পরিবর্তন।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, সার্স-কোভ ও সার্স-কোভ-২-- উভয় ভাইরাসই রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের এর মাধ্যমে মানুষের কোষের একই রিসেপটর ‘hACE 2/এইচএসিই ২’ (হিউম্যান এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২)-তে সংযুক্ত হয়। এইচএসিই ২-তে সংযুক্ত হওয়ার জন্য উভয় ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনে স্পাইক প্রোটিনের দুইটি হটস্পটস আছে। কিন্তু উভয় ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের হটস্পটগুলির 'স্পাইক প্রোটিন" গঠনে কিছুটা ভিন্ন হওয়ায়, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের দুইটি হটস্পটস, সার্স-কোভ এর দুইটি হটস্পটস এর তুলনায় এইচএসিই ২ এর সঙ্গে বন্ধনে অধিক স্থিতিশীল ও নিবিড়।

গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বের ৫৫টি দেশের ৩,৬০০ জন করোনা-রোগীর দেহ থেকে ভাইরাস-নমুনার আরএনএ সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা করেন ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স এর দুইজন গবেষক নিধান বিশ্বাস ও পার্থ মজুমদার (তথ্য সূত্রঃ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। তাঁদের গবেষণায় জানা গেছে, চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম সংক্রমণ ঘটায় ‘ও’ (‘O’) টাইপ নভেল করোনাভাইরাস, সার্স-কোভ-২। পরবর্তী চার মাসে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকভাবে মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটেছে SARS-COV-2 ভাইরাসটির গঠনে।

ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স এর গবেষণায়, ‘ও’ (‘O’) টাইপ করোনাভাইরাস থেকে জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত A2, A2a, A3, B, B1-সহ মোট দশ ধরণের করোনাভাইরাস গঠিত হয়েছে (তথ্য সূত্রঃ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক টাইপটি হচ্ছে--‘এ২এ’ ('A2a')। বিশ্বের বেশির ভাগ ভৌগোলিক এলাকাতেই ২০২০ সালের মার্চের শেষ নাগাদ থেকে নভেল করোনাভাইরাসের ‘এ২এ’ টাইপ আধিপত্ত বিস্তার করেছে।

২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ নামক ভাইরাসের সংক্রমণে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল। অন্যদিকে, নভেল সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ‘এ২এ’ টাইপ মিউটেশন (পরিবর্তন) মানুষকে সংক্রমিত করার অধিকতর সক্ষমতা অর্জন করেছে (তথ্য সূত্রঃ দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া)।  নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন ও ল্যানসেট জার্নালে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালের সার্স-কোভ ভাইরাসের চেয়ে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস বিশ্বব্যাপী অনেক বেশী সংক্রমণ, মৃত্যু ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান কোভিড-১৯ রোগের কারণে বিশ্বে ইতোমধ্যে ৩১ লক্ষ ১১ হাজারের অধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ ১৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে (তথ্য সূত্রঃ জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং)।

নভেল সার্স-কোভ-২ ভাইরাস প্রথমে নাক ও গলার কোষের এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) রিসেপটর ব্যবহার করে কোষে প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয়। ভাইরাস ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর বাহিরের আবরণে এক স্তরের "এপিথেলিয়াল কোষে" সমৃদ্ধ এসিই২ রিসেপটরে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে ফুসফুস আক্রমণ করে (তথ্য সূত্রঃ ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ)।

ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স এর দুইজন গবেষক নিধান বিশ্বাস ও পার্থ মজুমদার এর গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী, নভেল সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ‘এ২এ’ টাইপ মিউটেশন (পরিবর্তন) এর ফলে নভেল করোনাভাইরাসের বাহিরের স্পাইক প্রোটিনের গঠনে পরিবর্তন হওয়ায়, তা মানুষের ফুসফুসের কোষের বাহিরের আবরণের প্রোটিনের সাথে সহজে বন্ধন সৃষ্টি করে। ফলে শ্বাসকষ্টের মত লক্ষণ দেখা যায় এবং রোগটি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়