করোনা কি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সংক্রমণে কাজে লাগায়?
চলমান মারাত্মক সংক্রমক কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস SARS-CoV-2 এর কারণে বিশ্বে ইতোমধ্যে ২৯ লক্ষের অধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা দুই লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে (তথ্য সূত্রঃ জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং)। বাংলাদেশেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি প্রদত্ত সুপারিশগুলো (ঘন ঘন সাবান পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় হাত ধোয়া, অপরিস্কার হাতে মুখ, চোখ ও নাক স্পর্শ না করা, নিরাপদ সামাজিক শিষ্টাচার বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বাড়ির বাহিরে মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করা) একমাত্র অবলম্বন।
৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের "ন্যাচার" জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, সংক্রমণের সময়, নভেল করোনা (সার্স-কোভ-২) ভাইরাসের বাহিরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিন মানুষের শ্বসনতন্ত্রের কোষের ‘রিসেপটর’ প্রোটিনের (এসিই২ রিসেপটর/এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ রিসেপটর) সাথে সংযুক্ত হয়। ভাইরাসকে মানুষের কোষের ‘রিসেপটর’ গ্রহণ করে, যেমনটা একটি তালা একটি চাবিকে গ্রহণ করে। মানুষের কোষের তালার "চাবির ছিদ্র" কে নভেল করোনাভাইরাস চাবির মত ব্যবহার করে ভিতরে প্রবেশ করে। তারপর ভাইরাস কোষের অঙ্গাণুগুলো হাইজ্যাক করে রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করে এবং ব্যাপক ধ্বংসকার্য করে. (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েব সাইট "সায়েন্স" ও "লাইভ সায়েন্স")। মানুষের কোষের তালার "চাবির ছিদ্রকে" এসিই২ রিসেপটর (এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ রিসেপটর) বলা হয়।
এসিই২ রিসেপটর, কোষগুলোকে সুরক্ষিত না রেখেই সংক্রমণ সূচিত করতে ভাইরাসকে সহায়তা করে কারণ ভাইরাস কোষে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটাতে এই রিসেপটরের সাথে যুক্ত হয় (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের বিজ্ঞান ভিত্তিক ওয়েব সাইট "সায়েন্স")। যুক্তরাজ্যের ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইন্সটিউটের বিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রকাশনার প্রিপ্রিন্ট অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস নাকের অভ্যন্তরের আবরণে বসবাসের আদৃত জায়গা খুঁজে পায়। নাকের অভ্যন্তরের আবরণের কোষগুলো- এসিই২ রিসেপটর দ্বারা সমৃদ্ধ।
১ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী সার্স-কোভ-১ ভাইরাস মানুষের গলায় সংক্রমণ না করলেও, নভেল সার্স-কোভ-২ ভাইরাস গলার কোষের এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই২) রিসেপটর ব্যবহার করে কোষে প্রবেশের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। যদি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাথমিক অবস্থায় নভেল করোনাভাইরাসকে (SARS-CoV-2) প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তখন ভাইরাস বলিষ্ঠভাবে ফুসফুসকে আক্রমণ করতে শ্বাসনালী দিয়ে নিম্নমুখে অগ্রসর হয়। ভাইরাস ফুসফুসের বায়ুথলিগুলোর বাহিরের আবরণে এক স্তরের "এপিথেলিয়াল কোষে" সমৃদ্ধ এসিই২ রিসেপটরে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে ফুসফুস আক্রমণ করে (তথ্য সূত্রঃ ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ)।
বর্তমানে গবেষকগণ খুঁজে পেয়েছেন, মানুষের যে জিনটিতে (gene) "এসিই২ রিসেপটরের" সংকেত লেখা আছে তা (জিনটি) মানুষের দেহের "ইন্টারফেরনস" (interferons) প্রোটিনস দ্বারা উদ্দীপিত হয়। "ইন্টারফেরনস" হচ্ছে-- মানুষের দেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধের অন্যতম প্রধান (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")। যখন ভাইরাস মানুষকে সংক্রমণ করে, "ইন্টারফেরনস" "প্রথম প্রতিক্রিয়াকারী বা সাড়া দাতা" ("first responders") হিসেবে কাজ করে। "ইন্টারফেরনস" হচ্ছে সিগন্যাল প্রোটিনস পরিবার। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে এই প্রোটিনসকে উন্মুক্ত করে। জীবদেহে প্রতিটি প্রোটিনের সংকেত ডিএনএ (DNA) চেনের (শিকলের) বিভিন্ন অংশে লুকায়িত (লিখা) থাকে। ডিএনএ (DNA) চেনের মধ্যে সুনির্দিস্ট প্রোটিনের সংকেত বহনকারী অংশকে জিন (gene) বলে।
কিন্তু যখন "ইন্টারফেরনস" দেহকে করোনাভাইরাস আক্রমণের বিষয়ে সতর্ক করতে ব্যস্ত থাকে, তারা ("ইন্টারফেরনস") প্রকৃতপক্ষে একইসঙ্গে যে জিনটিতে (gene) "এসিই২ রিসেপটরের" সংকেত লেখা আছে, জিনটিকেও উদ্দীপিত করে; ফলে অধিক এসিই২ রিসেপটর উৎপন্ন হয়। কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV-2 অতিরিক্ত এসিই২ রিসেপটরের মাধ্যমে অধিকতর সংক্রমণ করে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েব সাইট "লাইভ সায়েন্স")।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর জোসে ওরডোভাস-মনটেন্স বলেন, "এসিই২ রিসেপটর" শুধুমাত্র কোষে ভাইরাসের প্রবেশের পথ নয়; এটি ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যাবলী এবং রক্তসংবহনতন্ত্রের কার্যাবলীতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ‘লাইভসায়েন্স’)। "এসিই২ রিসেপটর" দেহের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সরাসরি জড়িত। কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস (সার্স-কোভ-২) "এসিই২ রিসেপটর" কে মানবদেহে কোষে প্রবেশের পথ হিসেবে ব্যবহার করে এবং একইসঙ্গে এর ("এসিই২ রিসেপটর") স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বিকল করে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ওরডোভাস-মনটেন্স আরোও বলেন, "সার্স-কোভ-২ ভাইরাস, এসিই২ রিসেপটরকে লক্ষ্যকেন্দ্র করে (টারগেট)- আমাদের দেহের ভাইরাস প্রতিরোধী ব্যবস্থা ও কোষের-প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া/সাড়া নিজ কাজে লাগাচ্ছে।"
উচ্চ রক্তচাপ নিরোধক ওষুধ ‘লোসারটান’ কোষের প্রবেশ দ্বার এনজিওটেনসিন ২ রিসেপটর ব্লক করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। সার্স-কোভ-২ মানুষের কোষের এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং-এনজাইম-২ (এসিই-২) রিসেপটরের সাথে যুক্ত হয়ে সংক্রমণ করে। সেকারণে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, উচ্চ রক্তচাপ নিরোধক ওষুধ ‘লোসারটান’ এই রিসেপটরগুলো ব্লক করার কারণে, তা (লোসারটান) মানবদেহ কোষে করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাধাগ্রস্থ করতে পারে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের উপর এই উচ্চ রক্তচাপ নিরোধক ওষুধের প্রভাব জানতে দুইটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালু করেছে। অনেক গবেষক মনে করছেন, এসিই-২ রিসেপটর কেন্দ্রিক গবেষণা ও চিকিৎসা কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ রোধে ফলপ্রসূ হবে (তথ্য সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদ ওয়েবসাইট স্টাট নিউজ)। বিশ্বের কয়েকটি খ্যাতিমান ওষুধ কোম্পানী এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ আরম্ভ করেছে।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল: drmaasgar@gmail.com