ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম রোধে প্রযুক্তির ব্যবহার
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, ‘সমগ্র বিজ্ঞান দৈনন্দিনের একটি পরিশোধন চিন্তা ছাড়া আর কিছুই না’। তার ভাষ্য অনুযায়ী বলা যায়, বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনে অনেক সমস্যা রয়েছে যার মধ্যে একটি হল দুর্যোগের সময় ত্রাণ/ভাতা বিতরণে অনিয়ম যা পরিশোধন করতে বিজ্ঞানের বা তথ্য ও প্রযুক্তি যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
বর্তমানে টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঢুঁ মারলেই দেখা যায় ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অস্বস্তিকর গরম খবর। কখনো গুদামে, খাটের নিচে, মাটির নিচে, গোয়াল ঘরের ডেরা থেকে ত্রানের পণ্য উদ্ধার করছে প্রশাসন। করোনার এই দুর্যোগের সময় তাদের এই কার্যক্রম নৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার বহিঃপ্রকাশ। ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে করেকজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই অনিয়মের মহাসমারোহ দেখে এর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার পদ্ধতি নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংক সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সুশাসনের যে কয়টি সূচক দিয়েছে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বিজিএফ, বিজিডি পরিচালিত হয়ে আসছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদশ সরকার সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় ২৭১ বিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করেছে। যে কোন দুর্যোগ অথবা সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের সময় ভাতা/ত্রানের প্রদানের ক্ষেত্রে মোটামুটি পিরামিডটি হল, নীতিনির্ধারণী মহল>মন্ত্রণালয়>বিভাগ>জেলা>উপজেলা>ইউনিয়ন। এই পিরামিডের সবচেয়ে নিচের অংশে ইউপি চেয়ারম্যান এবং ইউপি সদস্যদের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় ভাতা অথবা ত্রাণ প্রাপ্তদের তালিকা।
জনগনের অসন্তোষ এই তালিকা প্রণয়ন নিয়েই এবং এইখানে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। এইখানে কে পাচ্ছে, কারা পাচ্ছে, কেন পাচ্ছে এগুলোর বিশদ বিশ্লেষণ দেয়া দরকার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য। তার পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদ একটি সুস্পষ্ট তালিকা প্রণয়ন করবে বিশদ বিশ্লেষণসহ। বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তি উন্নিতির চরম শিখরে পৌঁছেছে এটা নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন দেখছি না। এই তালিকা প্রযুক্তির সহায়তায় প্রকাশিত হবে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েবসাইটে যাতে যে কেউ উপকারভোগীদের তালিকা দেখতে পারে। তার পাশাপাশি ডাটা সরাররি প্রেরণ করবে কেন্দ্রীয় ডাটাবেজে।
এই ডাটাবেজ থেকে তথ্য নিয়ে সরকারের স্থানীয় অথবা কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল সরাসরি মোবাইলে যোগাযোগ করে জানতে পারবে তারা ভাতা অথবা ত্রাণ পেয়েছে কিনা। আশার কথা হল, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয় বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা এবং জবাবাদিহিতা নিশ্চিতকরণের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। তারা উপকারভোগীদের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করতে যাচ্ছে, যেখানে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের /জন্ম নিবন্ধন নম্বর এবং মোবাইল ফোন নম্বর থাকবে (১৯ এপ্রিল, banglanews24.com)। লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক ছাত্র এবং গবেষক হিসেবে সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। একই সাথে জোর দাবি জানাচ্ছি ভাতা/ত্রাণ প্রদানে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠন করর জন্য।
এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে পারলে অনিয়ম অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করা যায়। ফলে, ভবিষ্যতে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের বাস্তবায়ন এবং দুর্যোগের সময় খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা সহজতর হবে। অন্যদিকে বাস্তবতা হল, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার ফলে, সবাইকে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ভাতা অথবা দুর্যোগের সময় ত্রাণ এর আওতায় আনা সম্ভবপর নয়; কিন্তু যাদের জন্য যতটুকু বরাদ্দ দেয়া হয় ততটুকু যাতে মানুষের কাছ পৌছায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এই জন্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের বিকল্প নেই।
*তথ্যের বিভিন্ন উৎসের প্রতি আন্তরিকতার সাথে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি
লেখক: সহ-প্রধান গবেষক
বাংলাদেশ সেন্টার ফর কমিউনিকেশন প্রোগ্রামস (বিসিসিপি)