চোখেও দীর্ঘকাল থাকে নভেল করোনা?
দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, মানুষের জন্য ক্ষতিকর সাতটি করোনাভাইরাসের মধ্যে তিনটি করোনাভাইরাস, SARS-CoV- 1, MERS-CoV ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস, SARS-COV-2 মানুষের মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে বিশ্বের ৩৭টি দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ-১ নামক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৫০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮ হাজারের অধিক মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল। মার্স-কোভ করোনাভাইরাস তুলনামুলক ধীরে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছিল, তবে প্রাণঘাতীর হার ব্যপক ছিল। মার্স-কোভ করোনাভাইরাসে ২ হাজার ৫০০ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। ট্রেন্ডস ইন মাইক্রোবায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, সার্স-কোভ-১ ও মার্স-কোভ ভাইরাসের কারণে মারাত্মক অসুস্থতা সহ মৃত্যু হার যথাক্রমে প্রায় ৯% ও ৩৬% ছিল, তবে এ দুইটি ভাইরাসের সংক্রমণ সীমিত পর্যায়ে আছে।
বর্তমানে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর সংক্রমণ পূর্বের দুইটি ক্ষতিকর করোনাভাইরাসের চেয়ে বিশ্বে অনেক বেশী প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এই মারণ ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক চলছে। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে উল্লেখ করেছে, এই মারণ ভাইরাসটি ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়নি। এই ভাইরাসের বাদুরের দেহ থেকে কোন প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়েছে। এ নভেল ভাইরাসটি মারাত্মক ছোঁয়াচে এবং সেকারণে বর্তমান বিজ্ঞানের অনেক উন্নতির পরও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলমান মারাত্মক সংক্রমক সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের কারণে বিশ্বে ইতোমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ লক্ষ ৮৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং মৃতের সংখ্যা এক লক্ষ ৭৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী ‘সার্স-কোভ-২’ ভাইরাস হাঁচি, কাশি ও থুতুর মাইক্রো-ড্রপলেটের মধ্যে তিন ঘন্টা পর্যন্ত বাতাসে ভেসে থাকতে পারে এবং এই ভাইরাস মাইক্রো-ড্রপলেট হিসেবে প্ল্যাস্টিক, স্টেইনলেস স্টিল, পিজবোর্ড (পুরূ ও শক্ত কাগজবিশেষ) সহ অন্যান্য বিভিন্ন পৃষ্ঠের ওপর পতিত হয়ে আদ্র বা শুষ্ক অবস্থায় ঘন্টার পর ঘন্টা, এমনকি দিনের পর দিন টিকে থাকতে সক্ষম। মানুষ যদি কোন পৃষ্টের উপরে থাকা ভাইরাস (যেমন, প্ল্যাস্টিক, স্টেইনলেস স্টিল) হাত দিয়ে স্পর্শ করে, ভাইরাস হাতের চামড়ার সাথে লেগে যায়। সেকারণে মনে করা হচ্ছিল যে, নভেল করোনাভাইরাস হাতের সংস্পর্শ এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি ও থুতুর মাইক্রো-ড্রপলেটের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
কোভিড-১৯ রোগটি চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ১৭ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত "এনলস অফ ইন্টারন্যাল মেডিসিন" জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে জানা যায়, ২৩ জানুয়ারি, ২০২০ তারিখে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা উহান শহর থেকে এয়ারপ্লেনে ইতালী যান। পাঁচদিন পর বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণগুলো উপলদ্ধি করেন। ২৯ জানুয়ারি, ২০২০ তারিখে তিনি রোমের ন্যাশনাল ইন্সটিউট ফর ইনফেকশাস ডিজিস হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর প্রাথমিক লক্ষণগুলো ছিল, শুষ্ক কাশি, গলা ব্যথা, নাকের ভিতর প্রদাহ ও দুই চোখেই কন্জাঙ্কটিভাইটিস (চোখের ভাইরাসজনিত ইনফেকশন; চোখ লাল/ফেকাশে লাল হওয়া একটি উপসর্গ)। বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার হাসপাতালে ভর্তির দিনই রিয়েল-টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেন রিয়েকশন (real-time reverse transcription polymerase chain reaction/RT-PCR) এর মাধ্যমে থুতু/লালা (sputum) পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের (SARS-CoV-2) সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়।
হাসপাতালে ভর্তির চারদিন পর তাঁর জ্বর (38 °C) ও বমি আরম্ভ হয়। যেহেতু বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার প্রাথমিক লক্ষণগুলোর মধ্যে কন্জাঙ্কটিভাইটিস ছিল, সেকারণে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিন পর ডাক্তার তাঁর চোখের তরল পদার্থ (swab) সংগ্রহ করলেন এবং টেস্ট করে ভাইরাল SARS-CoV-2 RNA সনাক্ত করলেন। এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA (Ribonucleic acid) ভাইরাস পরিবার।
হাসপাতালে ভর্তির ২১ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন তাঁর চোখের তরল পরীক্ষা করে SARS-CoV-2 RNA পজিটিভ পাওয়া গিয়েছিল, তবে ভাইরাসের ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাচ্ছিল। তাঁর কন্জাঙ্কটিভাইটিস ১৫ দিনের মধ্যে অনেকখানি উন্নত হয়েছিল এবং ২০ দিনের মধ্যে পুরোপুরি আরোগ্য হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত "এনলস অফ ইন্টারন্যাল মেডিসিন" জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে জানা যায়, হাসপাতালে ভর্তির ২৭তম দিনে তাঁর নাক থেকে নিঃসৃত তরল পদার্থে SARS-CoV-2 ভাইরাস না পাওয়া গেলেও, চোখের তরলে সনাক্ত হয়েছিল।
১৭ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত "এনলস অফ ইন্টারন্যাল মেডিসিন" জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে লেখকগণ লিখেছেন, চোখের তরল পদার্থও কোভিড-১৯ রোগ ছড়াতে পারে। তাঁরা আরও গবেষণার পরামর্শ দিয়েছেন। উক্ত প্রবন্ধের লেখকগণ রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাগুলোর (ঘন ঘন হাত পরিস্কার এবং অপরিস্কার হাতে মুখ, নাক, চোখ স্পর্শ না করা, ইত্যাদি) বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল: drmaasgar@gmail.com