লকডাউনে আপনার শিশুর মানসিক দিকে লক্ষ্য রাখছেন তো?
কভিড-১৯ মহামারী সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এর অংশ হিসেবে দেশে এক ধরনের অঘোষিত লকডাউন চলছে। এর ফলে আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম, পারস্পরিক যোগাযোগ থেকে শুরু করে সবকিছুই আজ অনেকটা বন্দি। বর্তমানের এই অবস্থা, আমাদের সবার জন্যেই কঠিন। অনেকদিন ধরে ঘরে থাকার ফলে আমাদের মেজাজ হতে পারে অনেকটা খিটখিটে, বিভিন্ন ধরনের দুশ্চিন্তা আমাদের মনকে করে দিতে পারে অবসন্ন।
শিশু-কিশোররা এর ব্যতিক্রম নয়। এমনিতেই শিশু-কিশোররা চঞ্চল, বন্ধুসুলভ, খেলাধুলা ও বিনোদন প্রিয়; এরা পছন্দ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা-মজা করতে, খেলতে ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে। স্কুল ও বিনোদনপ্রিয় জায়গাগুলো বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা এইসব আনন্দ থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা আক্রান্ত হচ্ছে বাড়তি মানসিক চাপ এবং তাদের মাঝে দেখা দিতে পারে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া; যেমন- অস্থিরতা, উদ্বিগ্ন হওয়া, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, অল্পতেই রাগ করা, জেদি আচরণ করা ও ভয় পাওয়া।
সাধারণত এ সময়ে শিশুরা চায় পরিবারের বড়দের নিকট হতে একটু বেশি মমতা ও মনোযোগ। মানসিক চাপ ও সংকটের সময়ে শিশু-কিশোররা চায় বাবা-মায়ের আরো বেশি সংস্পর্শ, বাড়তি ভালোবাসা ও আদর। তাই এই সময় প্রয়োজন শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যত্ন।
এই সময়ে করণীয়:
# সন্তানের সাথে নিয়মিত কথা বলুন, তাদের প্রশ্নগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তার সঠিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন।
# শিশুদেরকে আশ্বস্ত করুন, তারা পছন্দ করে এমন বিষয় নিয়ে বেশি বেশি কথা বলুন; প্রয়োজনে তাদেরকে ইতিবাচক/শিক্ষামূলক গল্প শুনান। যেমন- ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দেশ, জেলা, ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধ।
# প্রয়োজনে তাদেরকে বই পড়ে শোনান, ছবি দেখান/ ছবি আঁকতে সাহায্য করুন, তাদের সাথে খেলাধুলা করুন, বারান্দা/ ছাদে হাটুন, যতটা সম্ভব বেশি বেশি সময় দেন। মনে রাখবেন এই বিষয়গুলো শিশুর সাথে পারিবারিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করবে।
# যতদূর সম্ভব শিশুর সুবিধা মাথায় রেখে দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করুন। যেখানে থাকবে- শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম, হালকা ব্যায়াম বিনোদনের ব্যবস্থা, স্কুলের হোমওয়ার্ক ও অন্যান্য পড়ালেখা।
# শিশুর পর্যাপ্ত সুষম খাবার নিশ্চিত করুন। খাবারে পর্যাপ্ত আমিষ, শর্করা, চর্বি , আশ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি রাখবেন।
# শিশুদের মাঝে দৈনন্দিন কিছু ভালো কাজের অভ্যাস গড়ে তুলুন- হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা, বারবার মুখে- নাকে হাত না দেওয়া, গড়গড়া করা, বড়দের সাথে শিষ্টাচার মানা, বাড়ির ছোট ছোট কাজগুলো করতে সাহায্য করার অভ্যাস করা। শিশুদেরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বেশি বেশি প্রশংসা করুন।
# করোনা মহামারী সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানান, ইতিবাচক ও সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো (সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা) বেশি করে অভ্যাস করান ও শিশুদেরকে আশ্বস্ত করুন। এতে শিশুরা বুঝতে পারবে যে আপনি তার পাশেই আছেন।
# অসুস্থ ও অসুস্থদের সেবাদানকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখান।
যে কাজগুলো বর্জনীয়:
# শিশুদের সাথে রাগ করে কথা বলা বা নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে কথা বলা পরিহার করুন।
# শিশু যদি কোন মন্দ আচরণ করে থাকে, তৎক্ষণাৎ বকাবকি না করে সেটি দ্রুত চিহ্নিত করুন এবং তাকে ভালো কাজের দিকে পরিচালিত করুন।
# শিশুদের সামনে অস্থির আচরণ, মন্দ অভ্যাস, মেজাজ বা উদ্বিগ্নতা পরিহার করুন। নিজের স্থির থাকবেন। মনে রাখবেন শিশুরা অনুকরণপ্রিয় এবং তারা সব সময় বড়দের কে অনুকরণ করে থাকে।
# শিশু-কিশোরদের সামনে বাড়ির অন্য সদস্যদের সাথে খারাপ আচরণ বা চিৎকার-চেঁচামেচি করে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।
# শিশু-কিশোরদের স্মার্ট ফোন, ঞঠ, কম্পিউটার, কার্টুন, ভিডিও গেমস ব্যবহার সীমিত করুন। বেশি ব্যবহারের ফলে এগুলোর প্রতি তাদের আসক্তি তৈরি হতে পারে এবং পরবর্তীকালে শিশুর মানসিক বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে ও শিশু সঠিক সময় এর পরিবর্তে দেরীতে কথা বলতে পারে।
মনে রাখবেন, পরিবারের সদস্যরাই শিশু-কিশোরদের একমাত্র ভরসা ও স্বস্তির জায়গা। তাই তাদের সাথে বেশীবেশী সময় কাটান, কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন, ভালো কাজের প্রশংসা করুন ও তাদেরকে আশ্বস্ত করুন। এতে আপনার সন্তানের মনোবল থাকবে আগের মতোই অটুট ও দৃঢ়।
ডা. মোঃ আবু তালহা
এমবিবিএস, এফসিপিএস (শিশু মেডিসিন)