করোনাভাইরাস নির্মূলে টিকার ভূমিকা এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রাপ্যতার সম্ভাবনা
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে, কোন ভাবেই সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না। আমেরিকা-ইউরোপের মত উন্নত দেশগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের সংক্রমণে, ভেঙে পড়েছে তাদের উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। করোনা ভাইরাসের কারনে পৃথিবীতে মারা গেছে দেড় লাখের বেশি মানুষ, আক্রান্তের সংখ্যা ২২ লাখেরও বেশি। তাই চাতক পাখির মত পৃথিবীর প্রায় সাতশ কোটি মানুষের অপেক্ষা কার্যকর ও নিরাপদ কোন চিকিৎসার দিকে।
বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের কারনে মহামারী পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় টিকা বা ভ্যাকসিনের দিকে মানুষের এত মনোযোগ কারণ পৃথিবীতে প্রায়শই অণুজীবের কারণে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, সময়ের সাথে সাথে তার সংক্রমণ বাড়তে থাকে, সাথে আবিষ্কার হতে থাকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন কৌশল এবং নির্দিষ্ট সময় পর নিয়ন্ত্রিত হয় তার সংক্রমণ। এই পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষের মধ্যে যতগুলো অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত রোগ এসেছে তার বেশীর ভাগ নির্মূল হয়েছে ওষুধ বা টিকা দ্বারা, কখনো এটি নির্মূল করতে লেগেছে কয়েক মাস কখনোবা কয়েক যুগ, কয়েক শতক।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লু, কলেরা ও গুটিবসন্তের মহামারীর কারনে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে কারণ তখন অণুজীব বিষয়ে মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। সাধারণত কোন মহামারীতে মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ বা তার উপরে সংক্রমিত হলেই প্রাকৃতিকভাবেই মহামারীর কমতে থাকে, উপরের ঐ সকল ভয়ংকর মহামারী গুলোর ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। আবার অণুজীব বিষয়ে জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের পরেও জিকা ভাইরাস, ইবোলা, এইচআইভি, হেপাটাইটিস-বি কিংবা সাম্প্রতিক কালের সার্স, মার্স, নিপা বা ডেঙ্গুর কারণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। কিছু ক্ষেত্রে টিকা আবিষ্কার করা গেলেও অনেক ক্ষেত্রে এখন সম্ভব হয়নি যেমন জিকা ভাইরাস, নিপা বা এইচআইভি, ফলে থামানো সম্ভব যায় নি অণুজীব সংক্রমিত রোগের কারণে মানুষের মৃত্যুর মিছিল।
করোনার বিস্তার কি নির্মূল করা সম্ভব?
সাধারণত অণুজীব সংক্রমিত রোগের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অণুজীবের সংক্রমণ ক্ষমতা আর অন্যটি রোগের মারণ ক্ষমতা। পৃথিবীতে দেখা গেছে যে সংক্রমণ রোগের মারণ ক্ষমতা বেশি তার সংক্রমণ ক্ষমতা কম যেমন সার্স, অন্যদিকে যার সংক্রমণ ক্ষমতা বেশী তাদের মারণ ক্ষমতা কম যেমন করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-19)।
নভেল করোনা ভাইরাস নতুন হওয়ায় পৃথিবীর বিজ্ঞানী বা গবেষকদের কাছে এই ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপাত্ত বেশি নেই। আবার দেখা যাচ্ছে করোনা ভাইরাস মিউটেশনের কারণে তার চরিত্রের পরিবর্তন করছে ক্ষণে ক্ষণে, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৩টি ভিন্ন ভিন্ন করোনা ভাইরাসের স্ট্রেইন আবিষ্কৃত হয়েছে; ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের বৈশিষ্ট্য ও মারণ ক্ষমতাও বিভিন্ন। তাহলে করোনা ভাইরাসের বিস্তার কি রোধ করা সম্ভব নয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ব বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট গুইডো ভ্যানহ্যাম ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ‘‘এক অর্থে বলতে গেলে, এই ভাইরাস আসলে থামবে না যতক্ষণ না আমরা তা থামাতে পারি। যতক্ষণ না আমরা এই ভাইরাসকে নির্মূল করতে পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত ভাইরাস তার বিস্তৃতি বাড়াতেই থাকবে’’।
আবার করোনা ভাইরাসের উপর ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব কি? সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছেন না কারণ ভাইরাসের মিউটেশনের কারণে এর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা ধরেই নিয়েছে সম্ভবত এর সংক্রমণের হার বছরব্যাপী কম-বেশি হতে পারে। এই সম্ভাবনা থেকে আমাদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না যে, এই ভাইরাসকে নির্মূল করতে সবচেয়ে মূখ্য উপায় হচ্ছে কার্যকর ও নিরাপদ টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা, যার মাধ্যমে এই অণুজীবকে নির্মূল করা যাবে।
করোনার চিকিৎসায় টিকার এতো প্রয়োজন কেন?
নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে আজ প্রায় সমগ্রবিশ্বে লকডাউন চলছে। তারপরও লাখ মানুষের মৃত্যুর মিছিল, তার অন্যতম কারণ এই রোগের কোন কার্যকর ঔষধ বা টিকা না থাকা। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানী বা গবেষকরা চেষ্টা করছে কিভাবে কত দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর ও নিরাপদ ঔষধ বা টিকা আবিষ্কার করা যায়। এ পথে তারা অনেকটা এগিয়েও গেছে। বিশেষ করে অনেকগুলো ওষুধের কার্যকারিতা মানবদেহে পরীক্ষার কাজ প্রায় শেষের দিকে, তাই হয়তো আগামী কিছু দিনের মধ্যই আমরা পেয়ে যাব কার্যকর ঔষধ। ফলে আমরা ভাবছি তাহলেই হয়তো বিশ্বজুড়ে প্রাণ রক্ষা পাবে লাখ লাখ মানুষের।
কিন্তু ওষুধ শাস্ত্রের ছাত্র হিসাবে বলতে পারি; ওষুধের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করা গেলেও নির্ভর করতে হবে রোগীর দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর। কারণ বেশীরভাগ ওষুধের কার্যকারিতা সাধারণত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, ফলে কোভিড-১৯ রোগীর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে কার্যকর ঔষধ দিয়েও তার মৃত্যু রোধ করা কঠিন হতে পারে। তাই ওষুধের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করা গেলেও এই অতি সংক্রামক ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করতে প্রয়োজন কার্যকর এবং নিরাপদ টিকার। টিকার মাধ্যমেই কেবলমাত্র বিশ্বব্যাপী সাতশো কোটি মানুষকে রক্ষা করা যেতে পারে এবং ফিরে আসতে পারে পৃথিবীর স্বাভাবিক অবস্থা। যেটি করা হয়েছিল গুটিবসন্তের মহামারীর ক্ষেত্রে এবং এই কঠিন ও জটিল কাজটি করতে তখন লেগে গিয়েছিল অনেক বছর।
কিভাবে তৈরি হতে পারে করোনা প্রতিরোধে টিকা?
করোনা ভাইরাস নির্মূলে টিকার ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাই এই মুহূর্তে পৃথিবীর বিজ্ঞানী বা গবেষকদের মনোযোগ কার্যকর টিকা আবিষ্কারের দিকে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে ৫০টির বেশী দল বা প্রতিষ্ঠান টিকা আবিষ্কারের কাজ করছে। এরমধ্যে কয়েকটি টিকার কার্যকারিতা এবং নিরাপদ কিনা তার পরীক্ষা করার জন্য মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে, ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরির এই দৌড়ে এগিয়ে যেতে সবাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
টিকা বা ভ্যাকসিন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে মানব শরীরে ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে এবং ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশের পর অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে ধ্বংস করে ফেলে। বর্তমানে চলমান ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছে বিভিন্ন পদ্ধতি। সেগুলোর নিম্নরুপঃ
১) নিষ্ক্রিয় করোনা ভাইরাস বা তার অংশ থেকে তৈরীকৃত করোনা ভাইরাসের টিকা, এখানে একটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাস বা তার অংশ বিশেষ মানব দেহে প্রবেশ করিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এটি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর উপায় যা বর্তমানের ব্যবহৃত বেশির ভাগ টিকা এই ধরনের কিন্তু এটি উৎপাদন ও বিশুদ্ধকরণের জন্য প্রয়োজন হবে জটিল পরিকাঠামো ও উন্নত যন্ত্রপাতি।
২) ডিএনএ ভিত্তিক করোনা ভাইরাসের টিকা, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যম ভাইরাসের ডিএনএ কোষের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে প্রোটিন সংশ্লেষণ করে নিদিষ্ট অ্যান্টিজেন তৈরি করা হবে যা পরবর্তীতে এন্টিবডি তৈরি করে দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হবে। যদিও টিকা তৈরি একটি জটিল ও কঠিন প্রক্রিয়া হলেও এটি তুলনামূলক সহজ এবং সাশ্রয়ী কিন্তু এখন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় তৈরি কোন টিকা মানব দেহে কার্যকর হয় নি।
৩) আরএনএ ভিত্তিক করোনা ভাইরাসের টিকা, এটিও নিদিষ্ট মাধ্যমে কোষের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে প্রোটিন সংশ্লেষণ করে নিদিষ্ট অ্যান্টিজেন তৈরি করা হবে যা পরবর্তীতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে দেহে ভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। এটিও তুলনামূলক ভাবে সহজ প্রক্রিয়া কিন্তু এই মুহূর্তে এই প্রক্রিয়ায় তৈরি কোন টিকা মানব দেহে কার্যকর হয় নি।
৪) গাছ থেকে তৈরিকৃত করোনা ভাইরাসের টিকা, যে প্রক্রিয়া তামাক গাছের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থেকে মানব দেহে ভাইরাস প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, কিন্তু এটির পরিশোধনের প্রক্রিয়া জটিল কারণ পৃথিবীতে এভাবে মানব দেহের টিকা তৈরির ইতিহাস খুব কম আছে।
কার্যকর ও নিরাপদ টিকা তৈরি একটি খুবই জটিল ও কঠিন প্রক্রিয়া। যেখানে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয় যেমন,
১) টিকা কি দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারবে? পারলেও কত দিন এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা অ্যান্টিবডি দেহে কার্যকর থাকবে? কারণ, আমরা দেখছি চীন সহ বিভিন্ন দেশে অল্পকিছু ব্যক্তি দ্বিতীয় বার একই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে।
২) টিকা দেহে ভিতরে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি করবে তা কিভাবে নভেল করোনা ভাইরাসকে ধ্বংস করবে? তাদের কার্যকরিতাই বা কতটুকু হবে?
৩) নতুন আবিষ্কৃত টিকা মানব দেহের জন্য নিরাপদ হবে কতটুকু? এবং মানব দেহের উপর তার স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কি হবে?
৪) আমরা দেখছি করোনা ভাইরাস বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন স্ট্রেইনের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে সুতরাং সমগ্রবিশ্বে একটি টিকা কার্যকর হবে নাকি অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন টিকার প্রয়োজন হবে?
এই খুবই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিষয়ের সমাধান জানার জন্য বিজ্ঞানীরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, আর তা জানা গেলে আমরা হয়তো কার্যকর ও নিরাপদ টিকা পেতে পারি।
টিকা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বিশ্বের সক্ষমতা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ কে সোয়াইন ফ্লু থেকেও ১০ গুণ বেশি মারাত্মক বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাই পৃথিবীর সকল দেশের সরকার প্রধানরা বিজ্ঞানীদের উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন দ্রুত সময়ের মধ্যে মানুষের জীবন রক্ষায় কার্যকর ও নিরাপদ টিকা আবিষ্কারের। কারণ পৃথিবীজুড়ে এই ভাইরাস নির্মূলে এটিই একমাত্র পন্থা। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দ্রুত টিকা আবিষ্কারের পথ সুগম করতে হয়তো নতুন টিকা কার্যকারিতা ও নিরাপদ পরীক্ষার অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হবে তারপরও যদি বিজ্ঞানীরা আগামী বছর কোন কার্যকর টিকা বাজারে আনতে পারে তাহলেই সমস্যার শেষ নয়। কারণ পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক টিকা, এই বিপুলসংখ্যক টিকা অল্প সময়ের মধ্যে তৈরির জন্য যে পরিকাঠামো প্রয়োজন তা বিশ্বজুড়ে নেই।
কারণ ওষুধ তৈরির পরিকাঠামো দিয়ে টিকা তৈরির মত জটিল ও কঠিন কাজ করা যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল যা নতুন করে তৈরি করা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে টিকা তৈরি যে পরিকাঠামো আছে তা ব্যবহার করেও দ্রুত এতো বিপুলসংখ্যক টিকা তৈরি সম্ভব নয়। কারণ বর্তমান পরিকাঠামো ব্যবহার করে প্রতিবছর কয়েক কোটি টিকা তৈরি করা হয়, যদি ২০২১ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হয় তবে দ্রুত নতুন পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে এক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে যেটা দরিদ্র রাষ্ট্রের জন্য প্রায় অসম্ভব। আর উন্নত রাষ্ট্র সেই সুযোগ ব্যবহার করবে ফলে টিকার মূল্য বেড়ে যাবে যা স্বল্পোনত ও উন্নয়নশীল দেশ গুলোর জন্য ব্যয়ভার কষ্ট সাধ্য হয়ে যাবে।
অন্যদিকে টিকা তৈরির পরিকাঠামো সমৃদ্ধ দেশগুলো যদি মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্য টিকা তৈরি বাদ দিয়ে শুধু করোনার টিকা উৎপাদন করে তাহলে অনন্য জীবন রক্ষাকারী টিকার সংকট দেখা দেবে পৃথিবীতে, আবার উন্নত রাষ্ট্রগুলো টিকা উৎপাদনের পর নিজেদের জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিজেদের জনগণের জন্য আগে ব্যবহার করবে, এমনকি ভবিষ্যতের জন্য মজুদ করতে পারে যা দেখা গিয়েছিল ২০০৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর ক্ষেত্রে সবার আগে অস্ট্রেলিয়া H1N1 ভাইরাসের জন্য টিকা আবিষ্কারের পর নিজেরা ব্যবহারের জন্য মজুদের আগে তারা রপ্তানি করেনি ফলে অনেক দেশই প্রয়োজনের সময় দ্রুত টিকা পায় নি, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকার ক্ষেত্রে সেটি যে হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এ মহামারী পরিস্থিতিতে টিকা আবিষ্কার হলে তার প্রাপ্যতা প্রয়োজন অনুযায়ী সমভাবে বণ্টনের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে এলক্ষ্যে আগামী মে মাসে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী টিকার মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। এ রকম একটি চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়েছিল বার্ডফ্লু (H5N1 ভাইরাস) মহামারীর ক্ষেত্রে, যদি কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এই ধরনের চুক্তি না হয় তাহলে টিকা মজুদের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে উন্নত দেশগুলো। এমন ঘটলে তৃতীয় বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের জন্য টিকার প্রাপ্যতা দীর্ঘায়িত হতে পারে, বিশেষ করে যাদের টিকা তৈরি সক্ষমতা নেই বলেই চলে। তাই বিশ্বব্যাপী টিকার প্রাপ্যতা দ্রুত নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, উন্নত রাষ্ট্রসমূহ ও বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে আরও আন্তরিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে হবে।
টিকা উৎপাদনে বাংলাদেশের সক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ প্রাপ্যতার সম্ভাবনা
করোনা ভাইরাস নির্মূলে টিকার অপেক্ষায় বাংলাদেশের প্রায় আঠারো কোটি মানুষ, তৃতীয়বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের ওষুধের ক্ষেত্রে ২০৩১ সাল পর্যন্ত মেধাসত্ত্ব ছাড় আছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গুলো কম দামে ওষুধ সরবরাহ করে দেশের চাহিদা মেটিয়ে অর্জন করছে বৈদেশিক মুদ্রা কিন্তু সেটা শুধু ওষুধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য টিকার ক্ষেত্রে নয়।
আমাদের দেশে টিকা তৈরির পরিকাঠামো খুব বেশী না থাকায় এটির জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় আমদানির উপর। বাংলাদেশে ২৫০শ টির বেশি ফার্মাসিউটিক্যালস্ কোম্পানিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র একটি কোম্পানির টিকা তৈরির পরিকাঠামো আছে। তারা কয়েকটি টিকা বাজারজাত করলেও তাদের দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। তাই এই প্রতিষ্ঠান নতুন টিকার জন্য উৎপাদনে গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা উন্নত দেশের কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন হবে, পাশাপাশি মনে রাখতে হবে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা প্রতি বছর ১ কোটি ৮০ লক্ষ, যা দিয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষকে সেবা দিতে তাদের কয়েক বছর সময় লাগবে, এই সময়ে উন্নত দেশ থেকে টিকা নিয়ে আসাও হবে কষ্ট সাধ্য কারণ সব দেশই আগে নিজেদের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করবে। আবার এ মহামারী পরিস্থিতিতে টিকা তৈরি জন্য দেশে নতুন পরিকাঠামো তৈরি করা হবে সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। সর্বোপরি দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে নির্ভর করতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও উন্নত বিশ্বের উপর যা হয়তো হতে পারে সময়সাপেক্ষ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: nk.kundubd@yahoo.com