১৬ এপ্রিল ২০২০, ২৩:১৩

সতর্কতা ও দেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থার মাধ্যমে করোনা মোকাবিলা কি বিজ্ঞান সম্মত?

  © টিডিসি ফটো

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এ প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, মানুষের জন্য ক্ষতিকর সাতটি করোনাভাইরাসের মধ্যে তিনটি করোনাভাইরাস, SARS-CoV (severe acute respiratory syndrome coronavirus), MERS-CoV (Middle East respiratory syndrome coronavirus) ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-COV-2 (severe acute respiratory syndrome coronavirus-2) মানুষের মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA (Ribonucleic acid) ভাইরাস পরিবার যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (মূলত ফুসফুস) সংক্রমণ করে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০২ সাল থেকে বিশ্বের ৩৭ টি দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ নামক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৫০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮ হাজারের অধিক সংক্রমিত হয়েছিল। মার্স-কোভ করোনাভাইরাস তুলনামুলক ধীরে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছিল, তবে প্রাণঘাতীর হার ব্যপক ছিল। মার্স-কোভ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ২ হাজার ৫০০ জন মানুষের মধ্যে ৩৫% মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। বর্তমানে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর সংক্রমণ পূর্বের দুইটি ক্ষতিকর করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ মারাত্মক হলে তীব্র শ্বাস কষ্ট সহ ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) ব্যাধিতে অসুস্থ হয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুসে সমস্যা বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের সার্স-কোভ-২ দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকি রয়েছে। তবে সিএনএন হেলথ সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কিছু শিশুসহ ২০-৫০ বছর বয়স্ক অসংখ্য মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসএসই) প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে ও মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

সকল ভাইরাসই মানুষের দেহের বাহিরে ঘন্টার পর ঘন্টা, এমনকি দিনের পর দিন সক্রিয় থাকতে সক্ষম। তারা সংস্পর্শ বা শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহ কোষে প্রবেশ করে স্বতস্ফুর্তভাবে অসংখ্য ভাইরাস সৃষ্টি করে। এই ভাইরাসগুলো পরস্পরের সাথে শক্তিশালি বন্ধনে যুক্ত থাকেনা, সেকারণে এদের বিচ্ছিন্ন করতে তীব্র রাসায়নিক পদার্থের (chemicals) প্রয়োজন হয় না। যখন মানুষের দেহের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কোন কোষ মারা যায়, ভাইরাসগুলো নতুন কোষে গিয়ে সংক্রমিত করে। মানুষের দেহই কোভিড-১৯ সহ সকল ভাইরাসের খাদ্য তথা বেঁচে থাকার উৎস।

আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিলে মুখ ও নাক দিয়ে যে ক্ষুদ্র তরল ড্রপলেট নিঃসৃত করে তা ভাইরাস বহন করে। হাঁচি/কাশির সময় ক্ষুদ্র তরল ড্রপলেটগুলো ১০ মিটার পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে। মনে করা হচ্ছে, ক্ষুদ্র তরল ড্রপলেটগুলো, যেগুলো অন্তত দুই মিটার (ছয় ফুট) দূরত্বে যেতে পারে, সেগুলো হচ্ছে করোনাভাইরাসের মূল বাহক (সূত্রঃ ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন)।

হাঁচি/কাশির ক্ষুদ্র তরল ড্রপলেটগুলো অবশেষে কোন পৃষ্ঠের (surface) উপর পড়ে এবং দ্রুত শুষ্ক হয়। কিন্তু শুষ্ক অবস্থায় ভাইরাস সক্রিয় থাকে। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস বাতাস সহ প্ল্যাস্টিক, স্টেইনলেস স্টিল, পিজবোর্ড (পুরূ ও শক্ত কাগজবিশেষ) এবং অন্যান্ন বিভিন্ন পৃষ্ঠের ওপর দীর্ঘ সময় সক্রিয় থাকতে সক্ষম। মানুষের চর্ম ভাইরাসের আদর্শ পৃষ্ট (surface)। মানুষের চর্মের (মূলত হাত) সাথে ভাইরাসের শক্তিশালী পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে সংযোগ হয়। মানুষ যদি কোন পৃষ্টের উপরে থাকা ভাইরাস (যেমন, প্ল্যাস্টিক, স্টেইনলেস স্টিল) হাত দিয়ে স্পর্শ করে, ভাইরাস হাতের চামড়ার সাথে লেগে যায়। যদি কেউ হাত দিয়ে মুখমন্ডল বিশেষভাবে মুখ, নাক ও চোখ স্পর্শ করে, ভাইরাস সংক্রমিত হয়। সাধারনত মানুষ প্রতি দুই থেকে পাঁচ মিনিটে একবার হাত দিয়ে মুখমন্ডল স্পর্শ করে (সূত্রঃ ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন)।

করোনাভাইরাসসহ অধিকাংশ ভাইরাস তিনটি মৌলিক উপাদান, রাইবোনিউক্লিক এসিড/আরএনএ (ribonucleic acid/RNA), প্রোটিনস (proteins) এবং লিপিডস (lipids) দ্বারা গঠিত হয়। শুধুমাত্র পানি দিয়ে হাত পরিস্কার করলে ত্বকের সাথে ভাইরাসের আঠালো (glue-like) পারস্পরিক শক্ত সংযোগ সম্পূর্নভাবে দূরীভূত করা সম্ভব নয়। কিন্তু সাবানের ফেনা/সাবানময় পানি (Soapy water) খুবই কার্যকর। সাবান ফ্যাটের মত পদার্থ (লিপিড) ধারণ করে, যাকে "এম্ফিফাইলেজ" (amphiphiles) বলা হয়। গাঠনিকভাবে "এম্ফিফাইলেজ" এর সাথে ভাইরাসের বাহিরের আবরণের দ্বিস্তর লিপিডের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। "এম্ফিফাইলেজ" ভাইরাসের বাহিরের আবরণের লিপিডসকে দ্রবীভূত করে। এইভাবে সাবান ভাইরাসের সাথে হাতের ত্বকের আঠালো শক্ত সংযোগ অপসারণ করা সহ ভাইরাসের লিপিড, আরএনএ ও প্রোটিনের মধ্যস্থিত "ভেলক্রো" এর মত (Velcro-like interactions) পারস্পরিক বন্ধন ছিন্ন করে। ফলে ভাইরাস ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

জীবানুনাশক.এলকোহল সমৃদ্ধ যৌগিক পদার্থ (সাধারণত ৬০-৮০% ইথানল সমৃদ্ধ) একইভাবে ভাইরাসকে নির্মুল করতে সক্ষম। তবে সাবান ব্যবহার করা শ্রেয় কারণ সাবান যুক্ত পানি দিয়ে হাতের সমস্ত অংশ সহজে পরিস্কার করা যায় যা এলকোহল দিয়ে সম্ভব না হতে পারে।

সম্প্রতি ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, আক্রান্ত ব্যক্তি প্রতি মিলিলিটার থুতুতে (sputum) সত্তর লক্ষ কপি কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস এবং একইভাবে কফেও উচ্চমাত্রায় ভাইরাস বহন করে। করোনাভাইরাস মূলত দুইভাবে, থুতু/হাঁচি/কাশির তরল ক্ষুদ্র ড্রপলেট এবং সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার করলে অনাক্রান্ত ব্যক্তি আক্রান্ত ব্যক্তির ভাইরাস বহনকৃত তরল ড্রপলেট থেকে অনেকাংশে রক্ষা পায়। N95 মাস্ক ভাইরাসের ড্রপলেট থেকে ৯৫% সুরক্ষা দেয় এবং N99 মাস্ক ভাইরাসের ড্রপলেট থেকে ৯৯% সুরক্ষা দেয় (সূত্র: আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স)। ‘N’ দ্বারা অন্তত ০.৩ মাইক্রোন ব্যাসের ক্ষুদ্র কণা ব্লক করার শতকরা সম্পর্ক বুঝায়। সম্প্রতি সিডিসি পরামর্শ দিয়েছেন, সার্জিকাল/মেডক্যাল মাস্ক না পাওয়া গেলে জনগণকে যে কোন কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করার জন্য।

মানুষ ভেদে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভিন্ন হয়। সেকারণে সিজনাল ভাইরাসে কেউ কেউ আক্রান্ত হয়, আবার অনেকে হয় না। এটি মানবদেহের এন্টিবডি নামক রোগ ধ্বংসকারী প্রোটিন তৈরির সক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়া ভেদে দেহের এন্টিবডিগুলো ভিন্ন হয়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত অনেকে সুস্থ হয়েছেন এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু ভাইরাস তো একই। বিষয়টি অবশ্যই দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। খাদ্যাভাষ সহ জীবনযাত্রার সঙ্গে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সুষম খাদ্য গ্রহণ গুরুত্বপূর্ন। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম, দুধ, মাছ, মাংস, শিম বা ডাল জাতীয় প্রোটিন সহ ভিন্ন জাতীয় (Diversity) শাকসবজি ও ফলমূল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ নিশ্চয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। Diversity অর্থাৎ ভিন্নতা গুরুত্বপূর্ন এ কারণে একই জাতীয় খাদ্যে উপকারী সকল উপাদান থাকে না। একসময়ে জাপানিজরা ছোটখাট জাতি ছিল কিন্তু নতুন প্রজন্মের জাপানিজরা সকলেই দীর্ঘকায়। রহস্যটা খাদ্যাভ্যাস সহ জীবনযাত্রার পরিবর্তনে নিহিত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, দেহের রোগ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে সুস্থ জীবনযাত্রার (অর্থাৎ সুষম খাদ্যাভ্যাস সহ পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ পরিহার, ধূমপান ত্যাগ ইত্যাদি) গুরুত্ব রয়েছে।

যেহেতু কোভিড-১৯ হচ্ছে ভাইরাল নিউমোনিয়া, সেকারণে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্যমান ফলপ্রসু প্রতিষেধকগুলো এ রোগে কার্যকরী নয়। ফ্লু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিষেধকগুলোও এ রোগ নিরাময়ে উপকারে আসছে না এবং বর্তমানে কোভিড-১৯ রোগের কোন ভ্যাকসিনও নাই। সেকারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত সুপারিশগুলোই (ঘনঘন হাত পরিস্কার, মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার এবং অন্য মানুষ থেকে দূরে থাকা) হচ্ছে রোগ প্রতিরোধের উপায়। কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির আরোগ্য-- দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করছে। সেকারণে অধিক ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের স্বাস্থবিধি মেনে চলা সহ অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন (কোয়ারেন্টাইনে) থাকাটা অত্যাবশ্যক।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল: drmaasgar@gmail.com