করোনাভাইরাস মারাত্মক আক্রমনাত্মক হওয়ার কারণ ও চিকিৎসার আশাপ্রদ সম্ভাবনা
- ড. মু. আলী আসগর
- প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২০, ০১:০৮ PM , আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২০, ০১:০৮ PM
চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নভেল করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর কারণে সৃষ্ট রোগ কোভিট-১৯ এর উৎপত্তিস্থল হিসেবে চীনের সামুদ্রিক খাবারের বাজারকে ধারণা করা হচ্ছে। কিউরিঅস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথমে এই করোনাভাইরাসের নাম দিয়েছিল ‘২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস’ বা ‘২০১৯-এন-কোভ’ এবং পরবর্তীতে গবেষকরা ‘২০১৯-এন-কোভ’ এর সঙ্গে ২০০২-২০০৩ সালে সংঘটিত মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ (পুরো নাম সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম-কোভ) এর বেশ মিল খুঁজে পাওয়ায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নতুন ভাইরাসটির নামকরণ করেছে সার্স-কোভ-২।
গত ৩০ মার্চ বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় জানা যায়, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জেনেটিক বিশ্লেষণ করে বাদুরের দেহের ভাইরাসের সাথে অনেক সাদৃশ্য পাওয়া গেছে। বাদুর যেহেতু সামুদ্রিক খাবার বাজারে পাওয়া যায় না, সে কারণে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, চীনের সামুদ্রিক বাজারের প্যাঙ্গলিন প্রাণী বাদুর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ‘মাধ্যম’ হিসেবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে (সূত্র: ৬ মার্চ, ২০২০ তারিখের লাইভসায়েন্স.কম)।
দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো থেকে এ প্রাণীটি ব্যাপক হারে চীনে পাচার হয়ে থাকে। দেশটিতে প্যাঙ্গোলিনের গায়ের আঁশ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ও প্রাণীটির মাংসও একটি উপাদেয় খাবার বলে গণ্য করা হয়। ১৭ মার্চ, ২০২০ তারিখের ন্যাচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় স্পষ্ট হয় যে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে বা কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়নি। কোভিট-১৯ রোগের জন্য দায়ী এই ভাইরাসটি ইতোপূর্বে কখনও মানবদেহে পাওয়া যায়নি। চীন থেকে ছাড়িয়ে এ মারণ ভাইরাস সারা বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ হিসেবে দাঁড়ালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ ২০২০ তারিখে ব্যাধিটিকে একটি ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
করোনাভাইরাস পরিবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত-আলফা করোনাভাইরাস, বিটা করোনাভাইরাস, গামা করোনাভাইরাস, ও ডেল্টা করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালে আবির্ভূত সার্স-কোভ-২ হচ্ছে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণের জন্য দায়ী করোনাইভাইরাসগুলির সপ্তম প্রজাতি (সূত্র: ১৭ মার্চ, ২০২০ তারিখের ন্যাচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা)। তিনটি করোনাভাইরাস-SARS-CoV, MERS-CoV ও SARS-CoV-2 মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ হলেও, অন্য চারটি করোনাভাইরাস-HKU1, NL63, OC43 ও 229E মানুষের সামান্য ক্ষতি করার সক্ষমতা রাখে।
২০০২-২০০৩ সালের সালে সংঘটিত মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ এর সাথে ২০১৯-২০২০ সালের বৈশ্বিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর অনেক সাদৃশ্য থাকলেও, উভয়ের বাহিরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিনের গঠনে পার্থক্য রয়েছে। করোনাভাইরাসের বাহিরের আবরণে স্পাইক প্রোটিনগুলো একত্রিত হয়ে ট্রাইমারস গঠন করে (স্পাইক প্রোটিনের সংগৃহীত ছবি/ATTACHED)। ভাইরাসের বাহিরের স্পাইক প্রোটিনের আবরণ বৈশিষ্ট্যসূচক মুকুটের সদৃশ্য হওয়ায় এর নাম করোনাভাইরাস।
৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, সার্স কোর্ভ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের গঠন জেনেটিক্যালি ‘mutations’ (মিউটেশন) এর মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে নতুন স্পাইক প্রোটিনের গঠন হওয়ার ফলে সৃষ্ট ভাইরাস সার্স-কোভ-২ (কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস) মানুষের কোষকে পূর্বের চেয়ে অধিকতর আক্রান্ত করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। ‘Mutation’ অর্থ কোষের জিনের পরিবর্তন। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি তার আবরণের স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষগুলিকে আক্রমণ করে।
৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কোভিট-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের (সার্স-কোভ-২) বাহিরের আবরণে স্পাইক প্রোটিনগুলো ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশী সন্নিবিষ্ট (compact) হওয়ায়, বর্তমানে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস দ্বারা মানুষের দেহের কোষগুলো শক্তভাবে সংযুক্ত হওয়াসহ রোগ বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ।
যেহেতু ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমণের দ্বারা দেহ থেকে খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে টিকে থাকে, সে কারণে ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণের সময় মানুষকে host/হোস্ট বলা হয়। সংক্রমণের সময়, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বাহিরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিন মানুষের (হোস্ট) শ্বসনতন্ত্রের (মূলত ফুসফুসে) কোষের ‘রিসেপটর’ প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হয়। ভাইরাসকে মানুষের (হোস্ট) কোষের ‘রিসেপটর’ গ্রহণ করে, যেমনটা একটি তালা একটি চাবিকে গ্রহণ করে।
৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষনা অনুযায়ী, সার্স-কোভ ও সার্স-কোভ-২ উভয় ভাইরাসই receptor-binding domain (RBD) এর মাধ্যমে মানুষের কোষের একই রিসেপটর ‘hACE 2/এইচএসিই ২’ (হিউম্যান এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২)-তে সংযুক্ত হয়। এইচএসিই ২-তে সংযুক্ত হওয়ার জন্য উভয় ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনে স্পাইক প্রোটিনের দুইটি hotspots (হটস্পটস), hotspot-31 (হটস্পট-৩১) ও hotspot-353 (হটস্পট-৩৫৩) আছে। কিন্তু উভয় ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের হটস্পটগুলির গঠনে কিছুটা ভিন্ন হওয়ায়, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের দুইটি হটস্পটস, সার্স-কোভ এর দুইটি হটস্পটস এর তুলনায় এইচএসিই ২ এর সঙ্গে বন্ধনে অধিক স্থিতিশীল ও নিবিড়।
ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের অর্থাৎ সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের পূর্বের (২০০২-২০০৩ সালের) সার্স-কোভ ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের চেয়ে হোস্ট (মানুষ) কোষের এইচএসিই ২ এর প্রতি অধিকতর বন্ধন আসক্তি রয়েছে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের হটস্পটগুলোর স্পাইক প্রোটিনের ভিন্ন গাঠনিক বৈশিস্টের কারণে হোস্ট কোষের এইচএসিই-২’কে তীব্রভাবে আকর্ষণের মাধ্যমে আক্রমণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে কোভিট-১৯ রোগটি বিশ্বব্যাপী দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এবং তা স্থায়ী হচ্ছে।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন ও ল্যানসেট জার্নালে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালের সার্স-কোভ ভাইরাসের চেয়ে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস বিশ্বব্যাপী অনেক বেশী সংক্রমণ, মৃত্যু ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষকেরা কোভিট-১৯ রোগের ভাইরাসের দ্বারা মানুষকে আক্রমণের প্রোটিনের গঠন খুঁজে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট 'মনোক্লোনাল এন্টিবডিস' সার্স-কোভ-২ এর রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের সাথে হোস্ট কোষের এইচএসিই এর বন্ধন বাধাগ্রস্থ করতে পারে। তাই বর্তমানে ‘মনোক্লোনাল এন্টিবডিস’ সম্ভাবনাময় এন্টিভাইরাল ড্রাগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অধিকিন্তু, এক্সপার্ট অপেনিয়ন অন থেরাপিউটিক টারগেটস জার্নালের গবেষণার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ‘সার্স-কোভ-২ রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেন’ নিজেই কার্যকর ভ্যাকসিন হিসেবে সম্ভাবনাময়।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়