কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সম্ভাবনাময় কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশাল সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নতুন ভাইরাসটির নামকরণ করেছে সার্স-কোভ-২। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নতুন আবির্ভূত সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির কারণে সৃষ্ট রোগ ‘কোভিড-১৯’ নামে সুপরিচিত। চীন থেকে ছাড়িয়ে এ মারণ ভাইরাস সারা বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ হিসেবে দাঁড়ালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ ২০২০ তারিখে ব্যাধিটিকে একটি ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আমাদের চারপাশে অনেক ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া আছে। কিন্তু আমরা সচরাচর এগুলো দ্বারা আক্রান্ত হই না। কারণ আমাদের শরীরে এসব জীবাণুর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে আছে। কিছু কিছু রোগের (যেমন- ডিপথেরিয়া, পোলিও, হাম, মাম্পস, যক্ষা ইত্যাদি) ভ্যাকসিন (প্রতিষেধক) আগেই শরীরে পুশ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে রাখা হয়। প্রত্যেক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্থাৎ এন্ডিবডি তৈরির সক্ষমতা ভিন্ন হয়। সে কারণে বিভিন্ন সিজনাল ভাইরাসের কারণে কিছু মানুষ আক্রান্ত হলেও, অনেকে আক্রান্ত হয় না।
যখন মানুষ যে কোন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, মানুষের দেহ এন্ডিবডি তৈরি করে ভাইরাসকে নির্মুল করার চেষ্টা করে। সুনির্দিস্ট ভাইরাসকে নির্মুল করতে সুনির্দিস্ট এন্টিবডি আবশ্যক অর্থাৎ ভাইরাসের ধরণের উপর নির্ভর করে কার্যকর এন্টিবডির ধরণ।
সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারির কারণ সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি ইতোপূর্বে কখনও মানবদেহে পাওয়া যায়নি এবং এর প্রতিষেধক এখনো তৈরি হয়নি। কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাঁর রক্তে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি হতে থাকে। মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভিন্নতার কারণে এন্টিবডি তৈরির সক্ষমতা ভিন্ন হয়। মানুষের দেহে এন্টিবডির মাত্রা সর্বোচ্চ হলে (strong immune response) ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে।
সুস্থ হওয়া কোভিড-১৯ রোগীর রক্তের স্ট্রং ইমিউন রেসপন্স (শক্তিশালি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) প্লাজমা দিয়েই করোনা রোগীর চিকিৎসায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এমন কি যাঁরা কোভিড-১৯ রোগীর সেবা দান করেন বা সংস্পর্শে থাকেন, তাঁদেরকে আগে থেকেই কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি দিয়ে করোনা প্রতিরোধী করা সম্ভব বলে মনে করছেন।
রক্তের লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা ও প্লাটিলেটস সরিয়ে ফেলার পর যে ঈষৎ হলুদ রঙয়ের স্বচ্ছ তরল পদার্থ পাওয়া যায়, তাকে ‘প্লাজমা’ বলে। ‘প্লাজমা’ এন্ডিবডি নামক এক ধরণের প্রোটিন ধারণ করে যা ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করে।। এই এন্ডিবডিগুলো মানুষের দেহে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ২৭ মার্চ, ২০২০ তারিখের জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ জন কোভিড-১৯ এ মারাত্মক আক্রান্ত চায়নিজ রোগীকে ‘কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ প্রয়োগে সফল ফলাফল পাওয়া গেছে।
Convalescent অর্থ রোগ থেকে আরোগ্যলাভকারী। যেহেতু রোগী সুস্থ হবার পর তাঁর থেকে এই প্লাজমা নেয়া হয়, তাই এর নাম ‘কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা’। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে, ‘কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ বলতে কোভিড-১৯ রোগ থেকে আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তির (ডোনর/দাতা) দেহ থেকে ‘প্লাজমা’ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে বা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে ব্যক্তির দেহে (রোগীর সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তি, যেমন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী) ট্র্যান্সফার করাকে বুঝায়।
ভাইরাস নির্মুলকারী এন্ডিবডি সমৃদ্ধ ‘প্লাজমা’ আক্রান্ত/সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে দেওয়া হয় এবং রক্তের লোহিত কণিকা ও শ্বেত কণিকা ডোনরের/দাতার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করে এবং দাতার রক্তের কোভিড-১৯, HIV ও হেপাটাইটিস পরীক্ষার পর ভাইরাস মুক্তের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েই কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন হেলথ এন্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির ভাইরাল ইমিউনোলজিস্ট মার্ক স্লিফকার ভাষ্যমতে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে ভাইরাসের সাথে লড়াই করার জন্য এন্ডিবডি নামক ব্লাড প্রোটিনের সৃষ্টি হতে থাকে। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পর তাঁদের দেহ থেকে প্লাজমার মাধ্যমে এন্ডিবডি সংগ্রহ করা হয় কারণ এই সময়ে শক্তিশালি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে।
ল্যানসেট ইনফেকশিয়াস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষকদের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে মার্স/MERS (মিডল ইস্ট রেসপাইরেটরি সিনড্রোম) করোনাভাইরাস চিকিৎসায় ‘কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ সফল হয়েছিল। ক্লিনিক্যাল ইনফেকশিয়াস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষকদের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাস চিকিৎসায় ‘কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ সফলতা পেয়েছিল।
ইউএসএ টুডে নিউজ পেপার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২৪ মার্চ, ২০২০ তারিখে ইউএস ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক গবেষকগণের প্রতি মারণ কোভিড-১৯ জরুরী মোকাবিলায় প্লাজমা গবেষণার অনুমোদন ও অনুরোধের প্রেক্ষিতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ও হোস্টন শহরে ২৮ মার্চ, ২০২০ তারিখে কিছু কোভিড-১৯ আক্রান্ত আমেরিকানের প্রত্যেকের শিরায় এক পিন্ট (প্রায় অর্ধ লিটার) পরিমাণ convalescent plasma (কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা) দেওয়া হয়েছে, যা ‘কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ নামে পরিচিত।
কোভিট-১৯ রোগের জন্য দায়ী সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি নতুন ও পূর্বের করোনাভাইরাসগুলির (২০০২-২০০৩ সালের সার্স-কোভ ও ২০১২ ও ২০১৫ সালের মার্স-কোভ) চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী। বর্তমানে কোভিট-১৯ চিকিৎসায় কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে। আশা করা যায়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই গবেষণা সফল চিকিৎসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। যদিও কোনভ্যালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ, কিন্তু বর্তমানে কোভিট-১৯ রোগের কোন বিকল্প চিকিৎসা না থাকায় মারাত্মক আক্রান্ত রোগীদের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে বলে বিবেচিত হচ্ছে।
বর্তমান মারাত্মক বৈশ্বিক মহামারি প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর পরামর্শ অনুযায়ী, ঘন ঘন সাবান/স্যানিটাইজার হাত পরিস্কার করা ও মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন। সকল ভাইরাসই মানুষকে আক্রান্ত না করা পর্যন্ত জীবনমৃতের মতো থেকে তারা চেষ্টা করে মানুষের দেহের কর্তৃত্ব গ্রহণে। মানুষের দেহের বাহিরে তারা জীবনবিহীন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তারা সংস্পর্শ, শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে মানুষের দেহের প্রোটিন খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ফলে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং মানুষের কোষগুলোকে আক্রমণ করে।
মানুষের দেহে বংশ বিস্তারের পর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত করতে থাকে। মানুষের দেহই কোভিড-১৯ সহ সকল ভাইরাসের খাদ্য তথা বেঁচে থাকার উৎস। ৩১ মার্চ, ২০২০ তারিখের ইউএসএ সংবাদমাধ্যম টাইম নিউজ পেপারের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষদের নিরাপদে সামাজিক শিষ্টাচার/দৈহিক দূরত্বে (social distancing) বা কোয়ারেন্টাইনে রেখে (অর্থাৎ আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত মানুষ থেকে অনাক্রান্ত মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে) মহামারি প্রতিরোধ সম্ভব। এইভাবে, নতুন সংক্রমণ রোধ করলে ভাইরাসটি টিকে থাকার মাধ্যম না পেয়ে খাদ্যাভাবে অনেকাংশে নির্মুল হয়ে যাবে।
লেখক: অধ্যাপক, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়