বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ কার্যকরভাবে মোকাবিলা
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে মহামারি হিসেবে নতুন আবির্ভূত ‘সার্স-কোভ-২’ ভাইরাসটির কারণে সৃষ্ট রোগ ‘কোভিড-১৯’ নামে সুপরিচিত। চীন ছাড়িয়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানির কারণ হিসেবে দাঁড়ালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ১১ মার্চ ব্যাধিটিকে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৯ সালে আবির্ভূত ‘সার্স-কোভ-২’ হচ্ছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর করোনাভাইরাইস পরিবারের ৭ম প্রজাতি (সূত্রঃ সেল হোস্ট এন্ড মাইক্রোব জার্নাল)। ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষকদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী প্যাঙ্গোলিনে ‘সার্স-কোভ-২’ সংশ্লিষ্ট করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বৈশ্বিক মহামারির কারণ এই ভাইরাসটি (সার্স-কোভ-২) ইতোপূর্বে কখনও মানবদেহে পাওয়া যায়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণগুলো হচ্ছে, জ্বর, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও খুসখুসে শুষ্ক কাশি। ‘সার্স-কোভ-২’ আক্রান্ত কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে সর্দি, গলা ব্যথা, নাক কনজেশন, এবং শরীরে ব্যথা বা ডায়রিয়া দেখা যায়। কারও স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়ার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যেতে পারে। আক্রান্ত ছয় জনের একজন মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্বাস কষ্টসহ ফুসফুস প্রদাহ (নিউমোনিয়া) ব্যাধিতে অসুস্থ হয়। বয়স্ক ব্যক্তিরা এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের ‘সার্স-কোভ-২’ দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার বিশাল ঝুঁকি রয়েছে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, যে কোনো বয়সের লোকই নতুন এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছে। সিএনএন হেলথ ৩১ মার্চ, ২০২০ তারিখে জানিয়েছে, কিছু শিশুসহ ২০-৫০ বছর বয়স্ক অসংখ্য মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আক্রান্ত হওয়া থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত কোন ব্যক্তি সংক্রমণের বিস্তার ঘটাতে পারে। সে কারণে দ্য জার্নাল এনালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে (রোগ সংক্রমণের আশঙ্কায় পৃথক রাখা) বা সক্রিয় পর্যবেক্ষণ করা উচিত। তবে মারাত্মক ক্ষেত্রে দীর্ঘতর সময় সক্রিয় মনিটর করা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ দ্রুত বিস্তারের কারণঃ
দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী ‘সার্স-কোভ-২’ ভাইরাস এ্যারোসল অবস্থায় তিন ঘন্টা পর্যন্ত বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। এ্যারোসল হচ্ছে, এ্যারো (aero অর্থ বাতাস) এবং সল (sol অর্থ সলিউশন বা তরল), অর্থাৎ তরল পদার্থের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা, যা মাইক্রো-ড্রপলেট (micro-droplets) আকারে বাতাসে ভেসে থাকে। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য মতে, ‘সার্স-কোভ-২’ ভাইরাস প্ল্যাস্টিকের উপরে ৭২ ঘন্টা, স্টেইনলেস স্টিলের উপরে ৪৮ ঘন্টা ও পিজবোর্ডের (পুরূ ও শক্ত কাগজবিশেষ) উপর ২৪ ঘন্টা টিকে থাকতে সক্ষম। ভাইরাসটি অন্যান্ন বিভিন্ন পৃষ্ঠের ওপর বেঁচে থাকতে পারে। সে কারণে এই মারণ ভাইরাস বাতাস সহ বাড়ি/ঘর/শপ/প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত জিনিষপত্র, গণপরিবহনে ব্যবহৃত আসন বা বডি পার্টসের মাধ্যমে বিস্তারে সক্ষম। ভাইরাসটি একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম হাত।
এই ভাইরাসটি মারাত্মক ছোঁয়াচে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি ও মলের মাধ্যমে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দিলে মুখ ও নাক দিয়ে তরল ড্রপলেট নিঃসৃত করে যা ভাইরাস বহন করে। বংশ বিস্তারের কারণে নতুন ভাইরাসের কপি/প্রতিলিপি মানুষের কোষে ধারাবাহিকভাবে বেশি হতে থাকে, ফলে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে আরও বেশি মানুষের কোষ আক্রমণ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাশির তরল ড্রপলেটগুলোই করোনাভাইরাসের মূল বাহক, আর এগুলো ছয়/সাত ফুট পর্যন্ত যেতে পারে।
কোভিড-১৯ কার্যকরভাবে মোকাবিলাঃ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ ‘সার্স-কোভ-২’ ভাইরাস প্রতিরোধে ইতোমধ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে।
সকল ভাইরাসই মানুষকে আক্রান্ত না করা পর্যন্ত জীবনবিহীন সুপ্ত অবস্থায় থেকে মানুষের দেহের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে। তারা সংস্পর্শ, শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে মানুষের দেহের প্রোটিন খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের ফলে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং মানুষের কোষগুলিকে আক্রমণ করে। মানুষের দেহে বংশ বিস্তারের পর হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে অন্যদের সংক্রমিত করতে থাকে। মানুষের দেহই কোভিড-১৯ সহ সকল ভাইরাসের খাদ্য তথা বেঁচে থাকার উৎস।
৩১ মার্চ, ২০২০ তারিখের ইউএসএ সংবাদমাধ্যম টাইম নিউজ পেপারের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষদের নিরাপদে সামাজিক শিষ্টাচার/দৈহিক দূরত্বে (social distancing) বা কোয়ারেন্টাইনে রেখে (অর্থাৎ আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত মানুষ থেকে অনাক্রান্ত মানুষকে বিচ্ছিন্ন রেখে) মহামারি প্রতিরোধ সম্ভব। এইভাবে, নতুন সংক্রমণ রোধ করলে ভাইরাসটি টিকে থাকার মাধ্যম না পেয়ে খাদ্যাভাবে অনেকাংশে নির্মুল হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে চীন, দক্ষিন কোরিয়া, ও সিঙ্গাপুর ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ অগ্রাধিকার দিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সাফল্য পেয়েছে। ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ হচ্ছে সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণ এবং যে কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সীমিত সাধ্যের মধ্যে ধরে রাখার মূলনীতি। ফলে, সামগ্রিকভাবে অল্প মানুষ সংক্রমিত হয় ও মৃত্যুবরণ করে। ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ নীতি অনুসরণ করে সবচেয়ে বেশী সফল হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া কারণ হিসেবে ২০১৫ সালের মার্স (MERS) ভাইরাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো, দ্রুত সক্রিয়ভাবে ভাইরাস মোকাবিলায় বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবরণী অনুযায়ী হাজার হাজার মানুষের কোভিট-১৯ রোগের ভাইরাসের পরীক্ষা করা, অনাক্রান্ত মানুষকে আক্রান্ত মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা, পর্যটক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে (সূত্রঃ ইউএসএ সংবাদমাধ্যম টাইম নিউজপেপার)।
পক্ষান্তরে, সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া হিসাবের বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমিত মহামারি কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে। দুইটি গ্রাফ প্রমাণ করে, যথাসময়ে ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’ অগ্রাধিকার দিয়ে দক্ষিন কোরিয়া যথেস্ট সফল হলেও, প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র হিমশিম খাচ্ছে (মার্চ ৩১, ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদত্ত দুইটি গ্রাফ)।
যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বৃদ্ধি পাওয়ায়, দক্ষণ কোরিয়ার মডেল অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সম্প্রতি ভাইরাস সংক্রমণ শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে ১০ সপ্তাহের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে (সূত্র ১ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন)। দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষকে ডায়াগনস্টিক টেস্টের আওতায় এনে অনাক্রান্তদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে কোয়ারেন্টাইনের পাশাপাশি ডায়াগোনেস্টিক টেস্টের মাধ্যমে আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের সনাক্ত করা জরুরী। সনাক্ত ছাড়া শুধুমাত্র কোয়ারেন্টাইনে রেখে রোগের স্থায়ী প্রতিরোধ কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ মানুষের দেহে সুপ্ত অবস্থায় থেকে যাওয়া ‘সার্স-কোভ-২’ ভাইরাস আপাত নির্মুল হয়ে পুনরায় মহামারি আকারে ফিরে আসতে পারে। অধিকিন্তু বিশ্বের আক্রান্ত সকল দেশকে প্রায়ই একই সময়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থাগুলো নেওয়া আবশ্যক। কারণ কোন দেশ/অঞ্চলের কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে ভাইরাসটি থেকে গেলে, বিদ্যমান উন্নত যোগাযাগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পুনরায় সমগ্র বিশ্বকে ছড়িয়ে দিবে।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল: drmaasgar@gmail.com