করোনা মোকাবিলায় চীন আমেরিকার বন্ধু না প্রতিপক্ষ?

  © ফাইল ফটো

করোনাভাইরাস আতঙ্কে রাতের ঘুম হারিয়ে গেছে বিশ্বনেতা, সাধারণ জনগণ, চিন্তাবিদ, চিকিৎসক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম করোনার উপস্থিতি ধরা পড়ে। এরপরে িকরোনা ছড়িয়েছে সারাবিশ্বে, মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে জ্যামিতিক গতিতে।

তবে, চীন ও উহান থামিয়ে  দিয়েছে এই মৃত্যুর মিছিলকে। নতুন করে করোনার উপকেন্দ্রে রুপান্তরিত হয়েছে, এখন পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের কাছে এখন করোনাভাইরাস এক দুঃস্বপ্নের নাম। কিন্তু,  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি পারবে চীনকে সঙ্গে নিয়ে করোনামুক্ত আমেরিকা বা বিশ্ব উপহার দিতে?

কেননা, চীনই হচ্ছে এখন পযর্ন্ত করোনা মোকাবিলা প্রথম সফল দেশ। চিরবৈরী এই দুই দেশ যদি শুভ বুদ্ধির ঘটিয়ে এক সঙ্গে কাজ করে, তবে সম্ভব দ্রুততম সময়ে করোনা প্রতিরোধ করা। করোনা হচ্ছে, এমন এক ভয়ানক ভাইরাস যার লাগে না কোন পাসর্পোট, না আছে কোন আর্দশ, না মানে নিদিষ্ট কোন সীমারেখা।  করোনা ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে।

সংক্রমণের সময় করোনা যাচাই করে না সে ব্যক্তি আমেরিকান, না চীনা, না ইতালিয়ান। যখন কোন সংকট আমাদের সামনে চলে আসে তখন আমাদের অনেকের একটি বৈশিষ্ট্য প্রতীয়মান হয়, কাকে এর জন্য দোষারোপ করা যায়। করোনা সংকটকালে সবচেয়ে যোগ্য ভিলেন মনে করা হচ্ছে চীনকে। কোথায় থেকে প্রথম করোনা ছড়িয়ে ছিল? উত্তর নিঃর্দ্বিধায় চীন।

এই করোনা সংকটকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে পারেনি কে? এই প্রশ্নের উত্তর সমালোচকরা নিঃসন্দেহে দিবে চীন। তবে চীনও পারে না একদমই দায়ভার এড়িয়ে যেতে। একারণে, শুরু থেকেই সন্দেহের তীর ছিল চীনের দিকেই।

ইতালির ন্যাশনালিস্ট লীগ পার্টির নেতা মাত্তেও সালভিনি এজন্য অভিযোগ করেছিলেন যে, চীনেই নাকি বিশ্বে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে ছড়িয়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস। একইসময়ে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও করোনাভাইরাসকে ‘চাইনিজ ফ্লু’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাহলে, কি সামনের দিনে এটি ‘আমেরিকান ফ্লু’ নামে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে। 

তবে, ভাগ্যিস এই যাত্রায় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এই বক্তব্য থেকে সরে এসে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। দিন যতই গড়িয়েছে ততই দেখা যাচ্ছে,  নির্দিষ্ট কোন দেশ বা জাতি এর জন্য দায়ী নয়। একারণে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হা এটিকে, ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। চীনকে দোষারোপ করে আমেরিকা যেমন তার ব্যর্থতা এড়িয়ে যেতে পারে না তেমনি ব্যর্থতা এড়াতে অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলো।

আমেরিকার নিজের ব্যর্থতা হচ্ছে যে, তারা এটিকে গুরুত্ব সহকারে নেয়নি। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া যখন জরুরী পদক্ষেপ নিয়ে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করলো তখন আমেরিকা কি করেছিল? আমেরিকা তাহলে নিঃসন্দেহে ২০১২ সালের মার্স,  ২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লু, ২০০৩ সালের সার্সের সংক্রমণ থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি।

দক্ষিণ কোরিয়া যেখানে প্রথম দিনে ১০ হাজার নাগরিক,  পরে ২০ হাজার নাগরিকের করোনা পরীক্ষা করল তখন আমেরিকা কি করেছিল? তাই অন্যকে দোষারোপ দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত? এই জন্য অন্যকে দোষারোপ না করে নিজেদের ব্যর্থতাগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে অন্যের সফলতাকে সাধুবাদ দেওয়া উচিত। চীনকে যতই দোষারোপ করা হউক না কেন,  চীনের ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং প্রথম ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ এই ভাইরাসের কথা বলেছিলেন।

তাছাড়া, ২০ জানুয়ারি,  ২০২০ চীনেই পৃথিবীকে প্রথম এই ভয়ানক ভাইরাস কিভাবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় তা বলেছিল। চীনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হাকে এই ভাইরাসের জীনোম, অসুস্থতার ধরণ জানিয়েছিল। চীনের দেওয়া তথ্যমতে, বোস্টনভিত্তিক কোম্পানি ম্যাডোনা দুইমাসের কম সময়ে এর ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করে এখন মার্কিন সংস্থা এফডিএয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়। চীন এই ভাইরাস ঠেকাতে সারা উহান,  হুবেই প্রদেশে ২১ জানুয়ারি থেকে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছিল।

সব জায়গায় চীন সরকার চেকপোস্ট, টেস্টের ব্যবস্থা করেছিল। চীন সরকার হোটেল, স্টেডিয়াম, স্কুলগুলোকে মেডিকেল সেন্টারে রুপান্তরিত করেছিল। তাছাড়া, চীন সরকার দশদিনে এক হাজার শয্যার জরুরী হাসপাতাল নির্মাণ করেছিল দ্রুততার সঙ্গে এবং চিকিৎসার সামগ্রী সরবরাহ করেছিল সর্বত্র। এই বিশাল প্রচেষ্টার সাথে জনগণের সহায়তার কারণে চীন এখন সফল।

এই কারণে, এখন আমেরিকার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপেল, স্টারবাকস ও ম্যাকডোনাল্ডস তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার খুলতে যাচ্ছে চীনে। অন্যদিকে, আমেরিকায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা। এজন্য, আমেরিকার উচিত হবে, শি চিন পিং যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানিয়ে হার্ড ডিপ্লোম্যাসি থেকে সরে গিয়ে সফট ডিপ্লোম্যাসির শুরু করা।

নতুবা, চীনে নতুন চিকিৎসা পণ্যের বাজার বা অথর্নৈতিক চাকার সচলতা প্রতীয়মান হচ্ছে তাতে দীর্ঘমেয়াদে পিছিয়ে পড়বে আমেরিকা। তাছাড়া, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্নদেশে চিকিৎসা সামগ্রীসহ ঔষুধ তৈরির কাচাঁমাল সরবরাহকারী বৃহৎ দেশ চীন অনেক আগে থেকেই। নিঃসন্দেহে তাই বলা যায় যে, মানবসভ্যাতার এই দুঃসময়ে এই দুই পরাশক্তির শুভ বুদ্ধির উদয়ে পারে বিপদ এড়িয়ে বিজয় নিশানকে ছড়িয়ে দিতে।

লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা


সর্বশেষ সংবাদ