ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলার এক বছর, কেমন আছেন নিউজিল্যান্ডের মুসলিমরা

  © সংগৃহীত

গত বছরের ১৫ মার্চ হঠাৎ নিস্তব্ধ ও বিস্মিত হয়ে পড়ে গোটা বিশ্ব । কেননা পৃথিবীর উন্নত ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরে জুমার নামাজের সময় আল নূর মসজিদ এবং ক্রাইস্টচার্চে লিনউড ইসলামিক সেন্টারে সন্ত্রাসীর উপর্যুপরি গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই গুলিবর্ষণ নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসবাদী হামলা। এতে প্রায় ৫০ জন নিহত হয় ও কমপক্ষে ৫০ জনের মত গুরুতরভাবে আহত হয়। অভিযুক্ত অপরাধী, অস্ট্রেলিয়ান ব্রেন্টন ট্যারেন্টকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ঘাতকের নির্বিচার গুলিতে মুহূর্তে মসজিদে রক্ত গঙ্গা বয়ে যায়। এই জঘন্য ও কাপুরুষোচিত হত্যা ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার করেছিল সেই ঘাতক। শান্তিপ্রিয় এমন একটি দেশে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বিদ্বেষী এই জঘন্য হামলায় গোটা বিশ্ব হতবিহবল ও শোকার্ত হয়ে পড়ে।

নিউজিল্যান্ড একটি উন্নত দেশ। দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত মানব উন্নয়ন সূচকের শুরুর দিকে অবস্থান নিউজিল্যান্ডের। শুধু তাই নয়, দেশটির জীবন-যাত্রার মান, প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল, শিক্ষার হার, শান্তি ও অগ্রগতি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অগ্রসরমান একটি দেশ। পৃথিবীর সর্বাধিক বাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের শহরগুলো অন্যতম মনে করা হয়। নিউজিল্যান্ড ওশেনিয়া মহাদেশের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। দেশটি অসংখ্য ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল স্টুয়ার্ট দ্বীপ এবং চাথাম দ্বীপ।

নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। রাজধানীর নাম ওয়েলিংটন। নিউজিল্যান্ড ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ। এটি অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাসমান সাগরে মধ্যে অবস্থিত।নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণে জনমানবহীন এন্টার্কটিকা মহাদেশ। সেই হিসেবে দেশটিকে পৃথিবীর সর্ব দক্ষিণের দেশ বলা যায় অনায়াসে।ফিজি, টোঙ্গা এবং নুভেল কালেদোনি হলো নিউজিল্যান্ডের প্রতিবেশি রাষ্ট্র।

নিউজিল্যান্ডের আয়তন ২ লাখ ৬৭ হাজার ৭১০ বর্গকিলোমিটার। এটি পৃথিবীর ৭৫তম বৃহৎ দেশ। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী নিউজিল্যান্ডে বসবাস করে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইউরোপ, এশিয়া, মিডলইস্ট ও আফ্রিকাসহ নানা দেশের বহু মানুষ এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। নিউজিল্যান্ডে মোট জনসংখ্যা বর্তমানে ৪.৩ মিলিয়ন।

যার বর্তমান সংখ্যা ইউরোপিয়ান ৭১.২ শতাংশ, মাওরি ১৪.১ শতাংশ, এশিয়ান ১১.৩ শতাংশ, প্যাসিফিক ৭.৬ শতাংশ, মধ্যম পূর্ব লাতিন আমেরিকান, আফ্রিকান ১.১ শতাংশ, অন্যান্য ১.৬ শতাংশ অথবা বলা যায় ৫.৪ শতাংশ নাগরিকের পরিচয়ই অজ্ঞাত।
হরেক রকম জাতি-গোষ্ঠীর সমাগম হওয়ায় নিউজিল্যান্ডে বেশ কয়েকটি ভাষার প্রচলন রয়েছে। যার মধ্যে ইংরেজি ৮৯.৮ শতাংশ মাওরি,নিউজিল্যান্ডের আদিম অধিবাসীদের ভাষা হল মাওরি। ৩.৫ শতাংশ, সামোয়ান ২ শতাংশ, হিন্দি ১.৬ শতাংশ, ফরাসি ১.২ শতাংশ, উত্তর চীনা ১.২ শতাংশ, ইউ ১ শতাংশ।

ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে খ্রিস্টান ৪৪.৩ শতাংশ, হিন্দু ২.১ শতাংশ, বৌদ্ধ ১.৪ শতাংশ, খ্রিস্টান মাওরি ১.৩ শতাংশ, ইসলাম ১.১ শতাংশ, অন্যান্য ধর্ম ১.৪ শতাংশ, অজ্ঞাতপরিচয় ৮.২ শতাংশ।

নিউজিল্যান্ডে বর্ণবাদের সমস্যা তেমন ছিল না । শান্তিপূর্ণভাবেই বিভিন্ন জাতি দেশটিতে বসবাস করত। নিউজিল্যান্ডে মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল হিসেবেই পরিচিত। তবে গত বছরের ১৫ মার্চের ক্রাইস্টচার্চে অবস্থিত দুটি মসজিদে ভয়াবহ হামলার পর দেশটিতে মুসলমানদের মাঝে ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিউজিল্যান্ডে বর্তমানে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় লাখ খানেক।

দেশটিতে ইসলাম ধর্মের বিকাশ শুরু হয় ১৮৭০ সালে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইউরোপ, এশিয়া,মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ নানা দেশের বহু মানুষ এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের দেশটিতে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হয় মূলত অভিবাসীদের মাধ্যমে।সে সময় স্বর্ণ অনুসন্ধানকারী পেশার ১৫ জন চীনা মুসলমান জীবন জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডে। ওটাগোর ডানস্টানের স্বর্ণক্ষেত্রে তারা কাজ করতেন। পরে ১৯০০ সালের শুরুর দিকে গুজরাটের তিনটি মুসলিম পরিবার সেখানে বসতি স্থাপন করে। তারপর ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সময়ে পূর্ব ইউরোপ এবং ভারত থেকে আসা আরও কিছু অভিবাসী মুসলমান সেখানে বসবাস শুরু করে স্থায়ীভাবে।

নিউজিল্যান্ড সরকারের হিসাব মতে, ১৯৫০ সালে নিউজিল্যান্ডে মুসলমান অধিবাসী ছিল মাত্র ১৫০ জন। ১৯৬০ সালে এ সংখ্যা উন্নীত হয় ২৬০-এ। অভিবাসী মুসলমানদের বড় আকারে বসতি স্থাপন শুরু হয় ১৯৭০ সালে।সে সময় ফিজি থেকে আসা ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলমানরা নিউজিল্যান্ডে বসতি স্থাপন শুরু করে। তাদের অনুসরণ করে ১৯৯০ সালের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত অনেক দেশের উদ্বাস্তু মুসলমানরা পাড়ি জমায় নিউজিল্যান্ডে। এরপর থেকেই নিউজিল্যান্ডে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। নিউজিল্যান্ডের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ইসলাম অন্যতম। ১৯৯১-২০০৬ এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ছয়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিমদের অনেক অভিজ্ঞ ও পণ্ডিত আলেম এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। তাদের অনেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেছেন। নিউজিল্যান্ডে ইসলাম প্রচারে ও মুসলিমদের ধর্মীয় কার্যক্রমে তারা সবসময় নিয়োজিত।

মুসলিমরা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করে এ দেশে এসেছেন, এমন অনেক যোগ্য ও অভিজ্ঞ আলেমও রয়েছেন দেশটিতে।তারা নিউজিল্যান্ডে ইসলাম প্রচার ও সেখানকার মুসলিমদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করার পেছনে দিন রাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। নিউজিল্যান্ডের প্রায় ৭৭% মুসলমান বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছে।এখানে বসবাসরত মুসলমানদের অনেকেরই জন্ম ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আলবেনিয়া, তুরস্ক, যুগোস্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও আরব অঞ্চলে। তাদের অধিকাংশই ভারতীয়। অনুপাত হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে ২৯% ভারতীয়, আর মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ২১%।

মুসলমানরা ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও এগিয়ে রয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মুসলিম কমিউনিটিতে তাদের আবাসস্থল ঘেঁষে মসজিদগুলো গড়ে তোলা হয়েছে।নিউজিল্যান্ডের মুসলমানেরা তিনটি অঞ্চলে বসবাস করে।অকল্যান্ড অঞ্চল, বিশেষত অকল্যান্ড শহর ও উত্তর দ্বীপের দক্ষিণে খুব বেশি পরিমাণে বসবাস করে মুসলমান। দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ক্রাইস্টচার্চ শহরেও রয়েছে অনেক মুসলমান। বেশিরভাগ মুসলমান সাধারণ শ্রেণীর। তবে কিছু প্রশিক্ষিত পেশাদারও রয়েছেন।নিউজিল্যান্ডে প্রথম মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত ১৯৭০ সালে অকল্যান্ড শহরে।এছাড়া অকল্যান্ডে প্রায় পনেরটি মসজিদ রয়েছে। প্রতিটি মসজিদসংলগ্ন প্রতিষ্ঠানেই শিশুদের জন্য হেফজ, নাজরানা ও প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।দেশের বৃহত্তম শহর অকল্যান্ডের মুসলমানরা আল-মদিনা স্কুল নামে একটি ইসলামি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুসলিম ছেলেমেয়েদের উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত সহশিক্ষা চালু থাকলেও এরপর থেকে ছেলেদের পৃথকভাবে এবং মেয়েদের পর্দার সঙ্গে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে।

এছাড়াও বেশি কিছু হেফজখানাও গড়ে উঠেছে। কয়েকটি মসজিদের উদ্যোগে ‘সানডে স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ছুটির দিন শিশুদের দিনব্যাপী ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় তাতে। নিউজিল্যান্ডে ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজিল্যান্ড’ (FIANZ) নামে একটি সংগঠন রয়েছে। এটি ১৯৭৯ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউজিল্যান্ড সরকারের নিবন্ধিত সমাজসেবামূলক এই সংগঠনটি মুসলমানরা পরিচালনা করে থাকেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই তারা ইসলাম চর্চা, ইসলামী শিক্ষা, সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন ছাড়াও নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে আসছে। ফেডারেশন অব ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজিল্যান্ডের উদ্যোগে নিউজিল্যান্ডে ইসলাম সম্পর্কিত ভুল ধারণা নিরসনে উন্মুক্ত মসজিদ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এ নীতির ফলে হ্যামিলটনে ইসলামের ব্যাপারে ভুল ধারণা চিরদিনের জন্য পাল্টে গেছে। মুসলিমরা সংখ্যায় কম হলেও নিউজিল্যান্ডে বেশ আন্তরিকতা ও ধর্মভীরুতার সঙ্গে ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজ করে যাচ্ছে। এই ইতিবাচক পরিবর্তন অবশ্যই অনুসরণীয় একটি দিক।

নিউজিল্যান্ডে মুসলিমদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে ধর্ম পালন, ইসলামী রীতি-নীতিতে অভ্যস্ততায় তারা দারুণ সক্রিয়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন। এই উপলক্ষ্য কেন্দ্র করে তারা আন্তঃধর্মীয় আলোচনা, ইসলামি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ ভোজ এবং ইসলামি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজনও করেন।

মুসলমানরা নিউজিল্যান্ডে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনা করলেও ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে ভয়াবহ হামলা তাদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভয় সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাসী হামলা নিউজিল্যান্ডের মুসলমানরা কিছু ব্যক্তিগত নিপীড়নের শিকার হলেও নিউজিল্যান্ড সরকার সর্বদা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ফলে তারা পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে আসছে। তবে মসজিদের মিনার থেকে মাইকে আজান দেয়া দেশের আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।মুসলিম নারীরা পর্দার স্বাধীনতা উপভোগ করেন। রাস্তায়, জনসাধারণে এবং বাজারে হিজাব পরিধান করে থাকেন।


সর্বশেষ সংবাদ