বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষ
- এ এইচ এম নোমান
- প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২০, ১০:০১ AM , আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২০, ১০:০১ AM
কলকাতার বেকার হোস্টেলের পুরোনো দিনের অভিজাত কাঠের সিঁড়ি দিয়ে শব্দ পায়ে তিনতলায় উঠে বাম দিক হয়ে ডান কর্নারের রুমটিতে তিনি থাকতেন। তিনি ছিলেন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। যে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি তা এখন থেকে ১১০ বছরের পুরোনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি এখন জাতির পিতার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছি এবং আমি খুব অনুপ্রাণিত বোধ করছি। পাশের কক্ষে অনেক ছবি রাখা আছে। বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার ইয়াং বয়সের ছবি, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি ছবি স্থান পেয়েছে। আরো দেখতে পাই, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যখন ঢাকায় নেওয়া হয় তার বড়ো একটি ছবি স্মৃতি হয়ে এখানে আছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এবং বঙ্গবন্ধুর লিখাসহ কিছু মূল্যবান পুস্তক এই মিনি লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। আমার সঙ্গে হোস্টেলের যে দুজন ইয়াং ছেলে ছিল তাদেরকে বললাম এই স্মৃতিগুলো গ্রথিত করে রাখ যাতে ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে বোঝাতে পার। শহরের ধনীদের চিন্তা চেতনার মধ্যে থেকেও কেন তিনি একটি শোষণহীন সমাজ গড়তে চেয়েছেন এবং কেন তার মধ্যে এই চেতনা আসল তার সাক্ষী এখানেও আছে। বেকার হোস্টেলে ঢোকার মুখেই বস্তি রয়েছে। মনে হচ্ছে—বস্তি চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এটাও একটি উপলব্ধির ব্যাপার। যে এই লোকগুলো অসহায় ও সহায় সম্বলহীন, আর আমরা এইখানে দালানে বাস করছি এবং এই দালানটা কিন্তু লাল রঙের যা ব্রিটিশদের শোষণের একটি প্রতীক।
কীভাবে ভাষায় বর্ণনা করব বুঝতে পারছি না, আমি আবেগে আপ্লুত। বঙ্গবন্ধু বেকার হোস্টেলের যে রুমে থাকতেন আমি সেই রুমে প্রবেশ করেছি। তার সেই চেয়ার, উনি যেই খাটে ঘুমাতেন। খাটটি তিন থেকে চার ফুট চওড়া হবে। এখানে তিনি শুতেন। যে চেয়ারে বসে পড়তেন সে চেয়ারে অনেক সাহস সঞ্চার করে বসলাম। এই কাঠের চেয়ারটা ১০০ বছর ওপরের পুরোনো হবে, পড়ার টেবিলটাও সেই রকমই আছে। জানালা এবং দরজাটাও আগের মতোই আছে। শুধু দেওয়ালে নতুন কাঠের কাজ করা হয়েছে। এছাড়া বেশির ভাগই অরিজিনাল। আমি আমাদের জাতির পিতার ছাত্র অবস্থার রুমে বসা। এরচেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর কি হতে পারে ! বঙ্গবন্ধু যেই রুমটাতে ছিলেন কক্ষ নম্বর ২৪। তার পাশের রুমটার মাঝখানে দরজা করা হয়েছে। যেখানে স্মৃতিকক্ষের পাথরের ফলকে বঙ্গবন্ধু এখানে ১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষে ছিলেন লেখা আছে। তারই সেই হোস্টেলে এখন বাংলাদেশের দুজন ছাত্র আবাসিক থেকে পড়াশোনা করছে।
স্মৃতিকক্ষের পাশের দেওয়ালে ঝুলানো বঙ্গবন্ধু কাঁধে বুকে আদুরে জড়ানো তার কন্যা শেখ হাসিনার ছবি দেখে খুব তৃপ্তিবোধ করেছি আর ভেবেছি সব বাবাই তার মেয়েকে ভালোবাসেন কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেন না। কারণ এখনো অনেক মানুষ গরিব, দুর্দশাগ্রস্ত, অর্থনৈতিকভাবে কষ্টে আছে, শোষিত। তাই আমরা যাতে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই সে জন্যে আমাদের বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) কাজ করছেন। শোষণহীন সমাজব্যবস্থা তৈরি করার জন্য কাজ করছেন। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
এই বেকার হোস্টেলটি প্রথম থেকেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলছে এবং এখানে সবাই মুসলিম ছাত্র। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে স্মৃতি রক্ষার জন্য এ পুরাতন আসবাবগুলো যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করছে সেজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। এছাড়াও মমতাদির (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী) প্রতি আমাদের এমনিতেও দুর্বলতা আছে। কারণ তিনি আমাদেরকে কাছ থেকে দেখেন, খেয়াল করেন, বলেন। বাংলাদেশের প্রতি তার ভালোবাসা আছে। তিনি শাড়ি পরেন, তারচেয়েও বড়ো কথা সুতি শাড়ি পরেন। সবাই এরকম সাধারণ হয়ে চলতে পারেন না। এই ‘সাধারণ’ আমরা সবাই হতে পারি না । আমরা একটু ‘অসাধারণ’ হয়ে—থেকে সাধারণদের ‘জন্য’ চিন্তা করি। কাজ করি। তাদের কথা বলি। ‘সঙ্গে’ থাকি না এটা কিন্তু একটি বিশাল কালচারাল ফারাক। আমাদের একীভূত হতে হবে এবং আমাদের মন চিন্তা ধারণায় একাত্মতায় আসলে আমরা সকলেই এগিয়ে যেতে পারব। বেকার হোস্টেল ও ইলিয়ট হোস্টেলের মাঝখানে একটি মসজিদ আছে। চারদিকে চারটি গম্বুজ বিশিষ্ট একতলা একটি মসজিদ। পবিত্রতার বিশাল একটি মন নিয়ে এখানে থাকা যায়। যেমন প্রাকৃতিকভাবে, দুনিয়াবিভাবে এবং আখিরাতের চিন্তাও এখান থেকে করা যায়। এটা বিশাল একটা যোগ। এখানে বিয়োগের কিছুই নেই। এই যোগের ফলেই হয়তো বঙ্গবন্ধু এই হোস্টেলে ছিলেন। তখন তো তিনি বঙ্গবন্ধু হন নাই, শেখ মুজিবুর রহমান। সেখান থেকেই এই মসজিদ এই পরিবেশ এই সবুজ গাছগাছালি এই আকাশ এই বাতাস এই পবিত্রতা সবকিছু মিলেই বোধহয় মানুষের প্রেম নিয়েই উনি জাতির পিতা হতে পেরেছেন। এটারও একটা বিশাল সাক্ষী দেয় এই বেকার হোস্টেল। এখানে বেকার হোস্টেলের পাশে একটি নতুন বিল্ডিং উঠেছে। আমাদের গর্ব যে বাংলাদেশ সরকারের টাকায় বঙ্গবন্ধু বেকার হোস্টেলের যে রুমটায় থাকতেন তার পাশের জায়গায় একটা বাংলাদেশ হোস্টেল হয়েছে এবং একটি মাঠও আছে। এ মুহূর্তে চার-পাঁচ জন ছেলে ক্রিকেট খেলছে। সেই আমলে হয়তো ক্রিকেট ছিল না ফুটবল খেলত। ফুটবল খেলারও নেটের স্থাপনা আছে। মাঠে কিছু পুরোনো বাঁশ আছে হয়তো মিটিং করে। এটাও ভালো লাগল যে আমাদের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মেলবন্ধন এখানেও ফুটে ওঠে। আমরা এক ও একাত্মতায় আছি। যার যার নিজের জায়গা থেকে সে সে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। বেকার হোস্টেলের গেট দিয়ে বের হতে ওপরের দিকে ইংরেজিতে লেখা স্থাপিত ১৯১০ইং। বেকার গভর্নমেন্ট মুসলিম হোস্টেল, ৮ স্মিথ লেন, কলকাতা ৭০০০১৩। সাত আর তেরো অঙ্কে লেখা দেখে ভালো লাগল এ কারণে যে, জনশ্রুতিতে লাকি সেভেন হলেও আমার বেলায় আনলাকী থার্টিন প্রায় সময়ই দেখেছি লাকী। ওই দিনের সেভেন ও থার্টিন উভয়টি এই বঙ্গবন্ধুর বেকার হোস্টেল থাকাস্থল দেখে আমি ডাবল লাকী মনে করেছি।
World Thinkers & Writers Peace Meet উপলক্ষ্যে ২৭-৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ কলকাতায় ছিলাম। মহাত্মা গান্ধীর ১৫০ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে উত্সর্গ করা হয়েছে এই মিট। এই সুযোগে শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর রোজ মঙ্গলবার দুপুরে বেকার হোস্টেল ভিজিটের নিয়তে ৩৯ এ হরিশ চন্দ্র রোডস্থ হোটেল থেকে বের হই। হলুদ মিটার ট্যাক্সি ২০ রুপি বেশি দিতে হবে চুক্তিতে স্বপন ড্রাইভারের গাড়িতে রওনা দিলাম একাই। স্বপন কলকাতার রাস্তাঘাট সব চিনে, আলাপি। সল্টলেক, সুলতান মসজিদ, মৌলানা আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ হয়ে চা-দোকানপাট বস্তি ঘেরা ইলিয়ট হোস্টেল গেটে গাড়ি থামাল ঠিক মতোই। বেকার হোস্টেল গেট পাশ রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে, তাই ইলিয়ট হোস্টেলের গেট দিয়েই হেঁটে আমার চাহিত বেকার হোস্টেলের গেটে পৌঁছালাম। দারোয়ান জানালেন, সুপার বা বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের অফিসের অনুমতি ছাড়া বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকক্ষে প্রবেশ বা দেখা যাবে না। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি বঙ্গবন্ধুকে বা তার কক্ষে যেতে পারবো না বলে কি? কারণ জানতে চাইলে বলে, কয়েকমাস আগে একদল বাংলাদেশি গেটে বা হোস্টেলের আঙ্গিনায় হৈচৈ বা অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে, তাই এই বিধি ব্যবস্থা। সুপার বা এম্ব্যাসির নাম্বার চাইলাম। যাক শেষ পর্যন্ত বয়সের কারণে বা চেহারা দেখে পাসপোর্টের ফটোকপি দিয়ে সহসুপারের কক্ষে প্রবেশ করলাম। তিনি ছবি মোবাইল ফোনে ভিডিওসহ সবসহযোগিতা করে ঘুরে ঘুরে দেখান। সেই সুবাদেই আমার প্রাপ্তি ও স্বাদ ধারা বর্ণনা লিখা প্রকাশ।
সূত্র: জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাক, লেখক: এনজিও কর্মকর্তা