অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২০, ১২:২৯ PM , আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০, ০১:১৬ PM
শুভেচ্ছা রইল সমগ্র নারী জাতির প্রতি। সেই সঙ্গে বলি পুরুষ শাসিত সমাজে নারী নির্যাতনের পাশাপাশি বন্ধ হোক পুরুষ নির্যাতনও।সেক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমান সুরক্ষা পাক। দূর হোক অসাম্য, ভেদাভেদ ও বৈষম্য ।অনেক সংসারে স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধংদেহী মনোভাব কাজ করে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের অভাবে।" স্ত্রীকে যথেষ্ট পরিমাণে সময় দিন, না হলে যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্বাস করুন। সংসার আর যুদ্ধক্ষেত্র মনে হবে না। "(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )
১৯৭৫ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নারীর সম্মান, মর্যাদা, সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা, কর্মক্ষেত্রে তাদের সহাবস্থান, আমাদের জীবনে চলার পথের সার্বক্ষণিক সঙ্গী এই সবগুলো বিষয়ই নারী দিবসের প্রতিপাদ্য।নারী বড্ড বেশি অভিমানী ও ভালোবাসার আধার।
"মেয়েদের মনে ভালোবাসা ও অভিমান দুটোই থাকে বেশি। তাই অভিমানটাকে ভালোবাসার চেয়ে বড় করে দেখা যাবে না। তাই স্বামীদের উচিত স্ত্রীর সব অভিমান ভালোবেসে ভাঙানো!"( ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)
সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এটি ২০২০ সালে এসে মেনে নেওয়া অনেকের কাছে খুব কষ্টের। কেননা সংসার সুখের হয় নারী পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।তবে পুরুষের মন ভালো রাখার চমৎকার ফর্মূলা দিয়েছেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ - " মন ভালো রাখতে বউকে ফেসবুক, ফোনবুক, নোটবুকসহ সব ধরনের অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড দিয়ে দিন।"
ডাক্তার কে বলা হলো আপনি নারী দিবস সম্পর্কে কিছু বলেন। উনি তো শুরু করলেন নাড়ির গুণাগুণ দিয়ে।
এক নারী তাঁর প্রতিবেশীর সঙ্গে গল্প করছিলেন—আজ সকালে আমি এক ভিক্ষুককে ১০০ টাকা দিয়েছি।
—পুরো ১০০টি টাকা ভিক্ষুককে দিয়ে দিলেন? আপনার হাজব্যান্ড আপনাকে কিছু বলেনি?
—বলেছে, ‘ধন্যবাদ।’
নারী হোক পরস্পরের পরিপূরক মুখাপেক্ষী নয়।
আমাদের প্রত্যয় হোক নারীর কাছে বিপ্লবী হবার বীরপুরুষ হবার।বিপ্লবী চে গুয়েভারার দৃষ্টিতে, যুদ্ধে বিজয়ী হলেই বিপ্লবী হওয়া যায় না৷ প্রকৃত বিপ্লবী তো সেই যে স্ত্রীর মনের একমাত্র বীরপুরুষ।"
নারী জাগরণে অতুলনীয় কবি নজরুল ইসলামের কবিতাই নারী দিবসে নারীদের জন্য সবচেয়ে অমূল্য উপহার। যদি ধারণ করা যায়। কবির আহবান
সাম্যের গান গাই -
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
নরককুন্ড বলিয়া কে তোমা’ করে নারী হেয়-জ্ঞান?
তারে বল, আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে - শয়তান যে - নর নহে নারী নহে,
ক্লীব সে, তাই সে নর ও নারীতে সমান মিশিয়া রহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছে, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শাজাহান।
বর্তমানে নারীর ক্ষমতায়নের যুগ চলছে। নারীর পেশা ও পুরুষের পেশা আর আলাদা করে ভাবা হচ্ছে না।বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬২ শতাংশ নারী আয় বৃদ্ধিমূলক কাজে যুক্ত। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের একটি। লেখক ও সাহিত্যিক গোলাম মুরশিদ বলেছিলেন, "নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে নারীর যে ক্ষমতায়ন হয়েছে, তা আংশিক।"পত্রিকার খবর অনুযায়ী, দেশে বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত। বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৫৫ ভাগের ওপরে। এ ছাড়া পরিবার, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনপদ ইত্যাদিতে নারী নির্যাতন বাড়ছেই।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারী ও পুরুষকে একটি গাড়ির দু’টি চাকার সাথে তুলনা করেছেন। কেননা একটি চাকা ছাড়া পুরো গাড়িটাই অচল। তাই নারী ও পুরুষ যদি মিলেমিশে কাজ করে, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই।তিনি বলেন,“দেহের দু’টি চক্ষুস্বরূপ, মানুষের সবরকমের কাজকর্মের প্রয়োজনে দু’টি চক্ষুর গুরুত্ব সমান।”
বেগম রোকেয়া কখনোই পুরুষকে ছোট করে দেখেননি। তাই তো তিনি লিখেছিলেন,“আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।”
শুধু আজকে নারী দিবসে নয়। আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত হোক নারীকে ভালোবাসা ও সম্মান দেবার। কবি যেন এভাবে বলতে না পারেন
" রাস্তার চেয়েও সস্তা সে যে বস্তার চেয়েও ভারী
মানুষ হয়েও সঙ্গের পুতুল বঙ্গ দেশের নারী। "
'‘অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে।" এই প্রবাদ দ্বারা সমাজে নারীর অবস্থান সহজে অনুমেয় করা যায়।" অতি বড় ঘন্নী না পায় ঘর/অতি বড় সুন্দরী না পায় বর'’- এই প্রবাদ গুলো নারীকে হেয় করার জন্য পুরুষেরা সৃষ্টি করেছে।
জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিদ ও মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্ববিদ স্টিফেন হকিংয়ের ৭০ বছরে পদার্পন উপলক্ষে নিউ সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এতে হকিংকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি কি নিয়ে ভাবেন। উত্তরে হকিং বলেন, "নারী; এরা পুরোই রহস্যময়।"
বিগ ব্যাং, কৃষ্ণগহবরের মতো জটিল রহস্যের যিনি সহজ-সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তিনিই কিনা বুঝে উঠতে পারেননি নারী জাতিকে।এজন্যই হয়তো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-নারীর মন শত-সহস্র বছরের সখা-সাধনার ধন। অন্যকথায় নারীর মন পুরুষ বুঝবে কি করে, ঈশ্বরই বোঝেন না। একজন বিজ্ঞানী নাকি নারী নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিয়ে করেন। বিয়ের পর সেই বিজ্ঞানী গবেষণা কি সেটাই নাকি ভুলে গিয়েছিলেন। শেষ করি আরেকটি কৌতুক দিয়ে নারী বিদ্বেষী এক যুবক ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করল
—হে ঈশ্বর, তুমি নারীকে এত সুন্দরী বানিয়েছ কেন?
—যাতে তুমি তাকে ভালোবাস।
—তাহলে ঈশ্বর, তুমি নারীকে এত বোকা বানিয়েছ কেন?
—যাতে সে তোমাকে ভালোবাসে।
ইসলামে নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের আবরণস্বরূপ আর তোমরা তাদের আবরণ।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত-১৮৭)।
কোরআনে আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘নারীদের ওপর যেমন অধিকার রয়েছে পুরুষের, তেমনি রয়েছে পুরুষের ওপর নারীর অধিকার।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত- ২২৮)।