সিম্পল লিভিং বাট হাই থিংকিং

  © টিডিসি ফটো

বর্তমানে আর্থিক মানদণ্ড কিংবা ভোগ্যপণ্য কেনার সামর্থ্য বিবেচনায় মধ্যবিত্ত সংখ্যা বাড়ছে! অথচ একটা সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাকে ভাবা হতো সামাজিক নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে। সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মানেই ভাবা হতো ‘সিম্পল লিভিং বাট হাই থিংকিংথ। ফলে সমাজের এ শ্রেণিটার উপর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের আস্থা ছিল বেশ।কিন্তু বর্তমানে যারা মধ্যবিত্তে অবস্থান করছে তারা সামাজিক নেতৃত্বে ভূমিকা রাখতে পারছে কতোটুকু? কিংবা যারা সামাজিক নেতৃত্বে আসছে তারা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পবোধের চর্চায় কতোটুকু সোচ্চার? নাকি তারা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে? মূলত নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশ এখন ভোগের বাইরে চিন্তা করতে পারছে না।যারফলে ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে।ফলে ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে সমাজের সেই ‘সিম্পল লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিংথ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা! অথচ এর আগে সামাজিক সংকটে সবসময় এই শ্রেণির মানুষের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

মধ্যবিত্তের জীবনযাপন সাধারণ কিন্তু চিন্তার গতিশীলতা অন্যদের থেকে ভিন্ন।কিন্তু বর্তমানে যে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে তাদের অনেকের মাঝে সাধারণ জীবনযাপন ও চিন্তায় কতোটুকু গতিশীল কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাদের উপর নিশ্বাস ফেলতে পারছে কিনা সেটাও ভাবনার বিষয়! একটু ভেবে দেখলে সহজেই বুঝা যাবে,বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কেমন সোচ্চার ছিল! কিন্তু বর্তমানে আমরা আর্থিক দিক থেকেই যেন মধ্যবিত্ত সংজ্ঞাটা পাল্টাচ্ছি।যারা অর্থ কিংবা ভোগের দিক থেকে এগিয়ে কিন্তু সামাজিক দিক থেকে যোগ্য না হলেও মধ্যবিত্ত বলছি। যারফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা আজকাল বদলে যাচ্ছে।সামাজিক প্রতিক হিসেবে যাদের অবদান রাখার কথা ছিল তারা পিছিয়ে পড়ছে। কেবল আর্থিক মানদণ্ড, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য কেনার সামর্থ্য বিবেচনায় দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে।কিন্তু যারা নব্য মধ্যবিত্তের পরিমাপে আসছে সেই শ্রেণীর অনেকে অন্যের সম্পদ দখলকারী, দুর্বৃত্ত, পরজীবী শ্রেণি, লুটেরা, আত্মসাৎকারী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এখন আর তেমনভাবে সোচ্চার নয়।

কিন্তু এর আগে সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।সকলক্ষেত্রে এ শ্রেণিটার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিতে দেখা যেত। যারফলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদেরও ভরসা ছিল তাদের উপর। কিন্তু বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটার বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। ধনী শ্রেণির সম্পদের পরিমাণ দিন দিন বাড়লেও মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা যেন এক প্রকার স্থির হয়ে পড়েছে। । যার কারণে চাপের মধ্যে রয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবার।একদিকে কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তা বাড়ছে অন্যদিকে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে পিছিয়ে পড়ার মনোভাব দেখা যাচ্ছে। অথচ সমাজের এ শ্রেণিটা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন ও সরকারি সেবা খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

বাংলাদেশ উন্নয়নের দূর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকছে। অসাম্যতার সঙ্গে বেড়ে ওঠা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে উপার্জনের মানদণ্ড অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করছে।সমাজে অনেককে দেখা যায়,মেধা-মননে, সংস্কৃতিতে বিকশিত হতে পারেননি অথচ কোনো ব্যক্তি আর্থিক কাঠামোতে মধ্যম সারিতে অবস্থান করছে। অর্থনৈতিক অবকাঠামো শক্তিশালী হওয়ার কারণে দেখা যায়,অনেক মানুষ বিস্তর অর্থ উপার্জন করে থাকেন।ফলে আর্থিক দিক ও ভোগের ক্ষেত্রে তারা হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত। অথচ তারা এর আগে ছিল দরিদ্র ও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী।কিন্তু সামাজিক নেতৃতে নয় বরং আর্থিক ও ভোগের দিক থেকে তারা মধ্যবিত্তে অবস্থান করেছেন। তবে যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অবস্থান করছে তাদের মধ্যে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পোবোধের চর্চা আছে কি? অর্থাৎ এর আগে সমাজে মধ্যবিত্ত মানেই সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পোবোধের চর্চা এবং সামাজিক নেতৃত্বে ছিল সর্বেসর্বা।

বর্তমানে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করে অনেকে ধনকুবের হচ্ছে।ফলে বাড়ছে ধনবানদের সংখ্যা।আর বনেদি মধ্যবিত্তদের একটা অংশ পতনের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী কিংবা পূর্ববর্তী সময়ে যদি পর্যালোচনা করি তাহলে বুঝতে পারি,মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পোবোধের চর্চার মধ্য দিয়ে।

কিন্তু অর্থনৈতিক উল্লম্ফনের কারণে এখন নিয়ে মধ্যবিত্তের প্রসার ঘটে চলেছে। দারিদ্র্যমুক্তির মধ্য দিয়ে অনেকের উত্তরণ ঘটছে।যাদের মধ্যে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পবোধের কোনো চর্চা নেই। এক প্রকার আর্থিক ও ভোগ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে মধ্যবিত্ত সমাজ। বর্তমানে স্কুল শিক্ষক ও নিচের ধাপের কর্মকর্তাদের চেয়েও ফুটপাতের হকার,সিএনজি ও ট্যাক্সি চালকদের আয় বেশী।তাই বলে তারাও কি মধ্যবিত্ত? যদি হয় তাহলে সেটা কি ‘সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণিথ নাকি ‘অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণিথ?

ঢাকা শহরের এমন অনেক ভিক্ষুক আছে যাদের মাসিক আয় ও ভোগ মধ্যবিত্তদের সমপর্যায় কিংবা বেশী হতে পারে তাই বলে সেই ভিক্ষুক কখনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত হতে পারে কি? ঢাকায় একজন রিকশা চালকও দিনে ১০০০ টাকা আয় করতে পারে তাই বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংজ্ঞাটা যারা পাল্টাচ্ছে তাকেও মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত করা হবে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের আয় নিঃস্ব ভিক্ষুকের চেয়ে কম। কিন্তু আয়ের দিক হতে ভিক্ষুকটি শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়? তাই যারা এমনভাবে অবস্থান করছে তারা কেবল অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণিথ। কারণ সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাপন সাধারণ কিন্তু চিন্তার গতিশীলতা ঠিক অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতো নয়। সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা হচ্ছে সামাজিক নেতৃত্বের প্রতীক, সিম্পল লিভিং বাট হাই থিংকিং এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পবোধের চর্চার দিক থেকে অন্যদের থেকে ভিন্ন।

 

 


সর্বশেষ সংবাদ