মননের পরিবর্তন না আনতে পারলে এক দিনের আনুষ্ঠানিকতা অপমান
থার্টি ফার্স্ট নাইটের একটা অবজারভেশন আছে আমার। জানি হয়তো অনেকেরই এই লেখাটার জন্য নোংরামি করার সুযোগ-সুবিধে তৈরি হবে, তবুও লিখতেসি:
৩১ ডিসেম্বর আমাদের ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন করা হয় এবং সন্ধ্যার পর থেকে আইডি কার্ড ছাড়া কাওকে ঢুকতে দেয়া হয়না ক্যাম্পাসে। অর্থাৎ, পুলিশ যদি তাদের দায়িত্ব পালনে সফল হয়, তাহলে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টায় ক্যাম্পাসে কোনো "বহিরাগত" ছিল না।
১৬ই ডিসেম্বর আতশবাজি অনুমোদিত হলেও ৩১ ডিসেম্বর কোনো এক দৈব কারণে আতশবাজিতে নিষেধাজ্ঞা! এরকম হিপোক্রেসি দিনে রাতে দেখে দেখে আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে দেখে হয়তো কারোর মনে আর এই প্রশ্ন জাগেই নাই! ব্যক্তিগতভাবে আতশবাজি পছন্দ করিনা দুইটা কারণে, এক কয়েক সেকেন্ডের রোশনাইয়ের জন্য এত খরচ আমার কাছে অপচয় মনে হয়। যখন কারও চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন হয়, তখন দুয়ারে দুয়ারে হাত পেতেও অধিকাংশ জায়গা থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়! আর দুই, একের পর এক বিকট শব্দ হতে থাকে দেখে পাখিরা ভয় পায় রাতে। ক্ষতিগ্রস্তও হয়।অবশ্য যে দেশে মানুষের জীবনেরই দাম নাই, সেই দেশে পাখি কোন ছার! নিষেধাজ্ঞা প্রদানের পেছনে এই দুই কারণ তো অবশ্যই ছিলনা!
তো তাদের এই নিষেধাজ্ঞাকে মধ্যাঙ্গুলি দেখিয়ে ঢাকা ঠিকই থার্টি ফার্স্ট উৎযাপন করে দেখিয়ে দিলেও পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাতেও সমস্যা খুব বেশি দেখিনা।
ক্যাম্পাসের পরিবেশ মুটামুটি নিরাপদ মনে হওয়ায় রাতে হলের প্রোগ্রাম শেষ করে কয়েকটি ছোটবোনকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতে চেয়েছিলাম আধঘন্টার জন্য। এমনিতেও রাতের ক্যাম্পাস দেখার সৌভাগ্য হয়না আমাদের, বাংলাদেশ এখনো অতটা সভ্য হয়নাই মাশাল্লাহ! তার উপরে মাঝেমধ্যে প্রয়োজনে হলে দেরিতে ঢুকলে অনলাইন চটিটাইপ পোর্টালে হেডলাইন আসে, "গভীর রাতে হলে ঢোকেন শামসুন নাহার হলের ভিপি"! তো, বের হবার সময় দাদুরা জানায় তারা গেট খুলতে অপারগ, ম্যাডামের কড়া নির্দেশ গেট না খোলার। অবশ্য তার কিছুক্ষণ আগেই এক নেত্রী দলবল নিয়ে গেটের বাইরে যান। তারা সব নিয়মের উর্ধ্বে কিনা! তো আমি যখন ম্যামের কাছে পারমিশন নিতে যাই, তখন ম্যাম জানান প্রোক্টরের কড়া ইন্সট্রাকশন, রাতের বেলা কোনো মেয়েকে যেন হল থেকে বের না হতে দেয়া হয়, এটা নাকি "মানসম্মান" আর "নিরাপত্তা"র প্রশ্ন!
আমার খটকাটা এই জায়গাতেই লাগলো। অন্যদিন সম্ভব না জানি, কিন্ত যেদিন ক্যাম্পাসে ছাত্ররা আর পুলিশ ছাড়া কেউ থাকেনা, সেদিনও হলের মেয়েদেরকে থাকতে হয় বন্দী! গর্বিত ঢাবিয়ানদের গতরভরা ইগো আর ঢাবিয়ানুভূতি! তো বাইরে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক আর পুলিশ থাকার পরেও "নিরাপত্তা" র প্রশ্ন তোলা মানে তো ঢাবির কোনো ছেলে কিংবা পুলিশের কাছে ঢাবির ছাত্রীরা নিরাপদ না! অথচ এই ব্যাপারটার কারণে এখন পর্যন্ত কোনো ঢাবিছাত্র কিংবা পুলিশকে অপমানবোধ করতে কিংবা প্রতিবাদ করতে দেখলাম না! কারোর আত্মসম্মানে লাগল না বিষয়টা! কি দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ! উন্নয়নের যন্ত্রণায় টেকা দায় হয়ে গিয়েছে দেখে এখনো মেয়েদেরকে করতে হচ্ছে বন্দী জীবন যাপন!
মুজিব বর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে।
আর হ্যাঁ, সামনের নারী দিবসে রাতের বেলা, ঠিক রাত বারোটায় কোথায়, কি প্রোগ্রাম থাকবে জানিনা। তবে আমি ৩১ ডিসেম্বর রাতের প্রতিবাদ হিসেবে আগামী নারী দিবসে রাতের বেলা সকলপ্রকার আনুষ্ঠানিকতা থেকে নিজেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। মননের পরিবর্তন না আনতে পারলে বড় বাজেটের নারী দিবসের আনুষ্ঠানিকতা, একদিনের উৎযাপন অপচয়, হিপোক্রেসি, আর তার চাইতে অনেক বেশি অসম্মান!
লেখক: সহ সভাপতি, শামসুন নাহার হল সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।