০৪ মার্চ ২০২০, ১২:৩৬

‘ঢাবির বিরাট সংখ্যক শিক্ষক বোধহীন প্রেতাত্মায় পরিণত হয়েছে’

২০২০ সালের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের জন্য একটা চরম অবমাননাকর ঘটনা ঘটে। গত ৫ জানুয়ারি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের ছাত্রীদের মধ্যে শাড়ি বিতরণ নিয়ে মারামারি লাগে। তখন সেই হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষিকা জোবায়দা নাসরিন মারামারি থামাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তখন উনার ভাষ্য অনুযায়ী ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মীরা উনাকে মারধর করে। উনার চুল ধরে টেনে ফেলে দেয়। অশ্রাব্য গালি গালাজ করে।

নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক শিক্ষিকাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে আমরা এই ঘটনার কিছুদিন পরে ৪০ জনেরও বেশী শিক্ষক শিক্ষিকার সাক্ষর যোগাড় করে শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বরাবর একটি চিঠি দেই। আমাদের দাবি ছিল, অবিলম্বে একটি সাধারণ সভা ডেকে এই গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

সভাপতি মহোদয় বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত এই অজুহাতে সভা ডাকার সময় পিছোতে থাকে। সভাপতি সাহেব যখন সময় পেলেন তখন দেখা গেলো চিঠি উনি হারিয়ে ফেলেছেন। যাই হোক, শেষমেষ দেখা গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকাকে ছাত্রীরা প্রহার করল, গালিগালাজ করলো, এইরকম একটা ভয়ানক বিষয় নিয়ে কোন মিটিং ডাকার প্রয়োজন মনে করলেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি অনেক দিন ধরেই ছায়া প্রশাসন হিসেবে কাজ করছে। নিপীড়নের শিকার সাধারণ শিক্ষক শিক্ষিকাদের পাশে দাঁড়ানোর নজির আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই দেখছি না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে শিক্ষক সমিতির আসলে কাজ কি?

তাঁর চেয়ে গুরুতর প্রশ্ন হলো বছরের পর বছর শিক্ষক সমিতি এইভাবে সাধারণ শিক্ষকের স্বার্থ পরিপন্থী কাজ করে কিভাবে এতো এতো ভোট পেয়ে পুনর্নির্বাচিত হচ্ছে?

এর বড় একটা কারণ হলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট সংখ্যক শিক্ষক শিক্ষিকা জোম্বিতে, প্রাণহীন, বোধহীন প্রেতাত্মায় পরিণত হয়েছে। ইনারা ভুতের মতন নিঃশব্দে নীরবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, কোনমতে একটা ক্লাস নিলেন কি নিলেন না, তারপর চলে যান। যারা সরব, তাঁরা লাউঞ্জে বসে চায়ের কাপে দুনিয়া উল্টে ফেলেন। কেউ কেউ বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চ্চা করছেন, বই টই লিখে, গবেষণা করে উল্টে ফেলছেন, টকশোতে এসে একশ একটা নীতিকথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেসিক যে মানবিক গুণ একজন শিক্ষকের মধ্যে থাকা দরকার, নিজ প্রতিষ্ঠানে অন্তত এই ধরনের ভয়াবহ নিপীড়নের প্রতিবাদ, সেটি করার বিন্দুমাত্র মুরোদ নেই।

তো আমরা হয়তো এখন ভাবছি যে আমরা বেশ নিরাপদ আছি, কারো সাতে পাঁচে নেই। কিন্তু আজকে হলে একজন শিক্ষিকা লাঞ্ছিত হলেন। এখন এই ভয়ংকর অন্যায়ের প্রতিকার না হলে কিছুদিন পরে, কারণে অকারণে রাস্তাঘাটে এসে ছাত্রলীগের কর্মীরা এসে শিক্ষক শিক্ষিকাদের যখন ইচ্ছা হেনস্তা করবে।

জোবায়দা নাসরিনের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের সামগ্রিক ভূমিকা এটাই বোঝায় যে আমরা আসলে সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়