দেশের টাকায় শিক্ষা, বিদেশে সেবা!
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা লাভের মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করার আশায় পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। তবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পড়াশোনা শেষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দেশে ফেরার। সেখানে চাকরিতে প্রবেশ পরবর্তী সময়ে সেখানকার নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশে স্থায়ী হওয়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যার বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০১৬ সালে গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)। সেখানে বলা হয়েছিল, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে। তবে বছরের পর বছর এর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে।
অথচ এসব শিক্ষার্থীকে গ্রাজুয়েট করতে দেশের খরচ হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করতে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ টাকার অধিক, বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা সমাপনীতে ব্যয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা, আর একজন সরকারি মেডিক্যালের শিক্ষার্থীর পেছনে ১৫ লাখ টাকার অধিক। বাংলাদেশের এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে জনগণের করের টাকায়। প্রথম শ্রেণির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খরচ আরো বেশি। এছাড়াও বিদেশে পড়াশোনা চালানোর জন্য গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ।
দিন শেষে এসব শিক্ষার্থী যখন উন্নত জীবন লাভের আশায় পরদেশের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করে ফেলে, তখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, ‘আমও গেল ছালাও গেল।’ শুধু শিক্ষার্থীই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে নানান পেশার মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেলেও পড়াশোনা শেষে অনেকেই সেখানে থেকে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই আছেন যারা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদানের কারণে শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রির জন্য শিক্ষাঋণ বা শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। শিক্ষকেরা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে অবস্থানকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। বিদেশ যাওয়ার সময় শিক্ষকদের ছয় মাসের বেতন বা চাহিদা অনুযায়ী অর্থ দিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিদেশে অবস্থানকালেও তারা প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কিস্তিতে টাকা পেয়ে থাকেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশমাতৃকার ঋণ ভুলে অনেক শিক্ষকই অবশেষে বিদেশি কর্মক্ষেত্রে নিজেদের মেধাশক্তির ফলন ঘটান। দেশমাতার পরম যত্নে রোপিত বীজ, পরিচর্যার কথা কতটাই বা তাদের মনে থাকে সে আমার অজানা! তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এমন অনেক শিক্ষককেই দেখেছি, যারা বিদেশের আকর্ষণীয় বেতনের চাকরি ফেলে ছুটে এসেছেন দেশমাতার সেবা করে ঋণ পরিশোধের নিমিত্তে। তবে দেশে ফিরে তাদের জীবনসংগ্রামও খুব সহজ ছিল না। সে সব গল্প শিক্ষকদের মুখে শোনার পর মনটা গর্বিতচিত্তে আলোড়িত হয়,‘এটাই তো দেশপ্রেম!’
আমাদের তরুণ মেধাবীরা নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করে কেন স্থায়ীভাবে পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশপানে, সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি। দেশের তরুণ মেধাবী শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ জনশক্তি কেন বিদেশি কর্মক্ষেত্রের দিকে ঝুঁকে পড়ছে? দেশের প্রতি কিসের এত অভিমান তাদের? বিদেশগামিতার পেছনের কারণ কি শুধুই বিলাসবহুল জীবন, নাকি টিকে থাকার প্রয়োজন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, তৈলবৃত্তি, অনুন্নত বেতন, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবসহ নানাবিধ কারণে দেশ ছাড়ছে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব ও মেধাসম্পদের যথোপযুক্ত স্বীকৃতি না পাওয়ায় দিশেহারা তরুণেরা আশার আলোর খোঁজে পাড়ি জমাচ্ছে পরদেশে। দেশীয় চাকরির বাজারে বারবার ব্যর্থ হওয়া মেধাবী ছাত্রটিকেও বিদেশি কর্মক্ষেত্রে একজন সফল কর্মী হিসেবে প্রশংসিত হওয়ার নজিরও অনেক।
প্রয়োজন তরুণদের সহযোগিতা। বুকে প্রবল দেশপ্রেম নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে তারুণ্যকে। উচ্চশিক্ষা আর ব্যক্তিগত সুখের পেছনে ছুটে দেশের কাছে রেখে যাওয়া ঋণের হাতছানি যেন আমরা কেউই ভুলে না যাই। উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর নিজেদের মেধার বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে দেশমাতৃকার উন্নয়নে। যৌবন যখন তারুণ্যের, দেশ পরিবর্তনের চাবিকাঠিও তাদেরই হাতে। তারুণ্য জেগে উঠলে, জেগে উঠবে দেশের অর্থনীতি। (সূত্র: ইত্তেফাক)
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়