বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনী বিল গেটসের নায়ক বাংলাদেশী বাবা-মেয়ে
বিল গেটস, নিজের জীবন ও কর্মের জন্য অনেক মানুষের নায়ক। তাঁর কাছে নায়ক এমন অনেকে, যাঁরা বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন। তেমনি বাংলাদেশি সমীর সাহা ও তাঁর মেয়ে সেঁজুতি সাহা। তাদেরকে নিয়ে মঙ্গলবার নিজের ব্লগ ‘গেটসনোটে’ লিখেছেন বিল গেটস
বাংলাদেশি মেয়ে সেঁজুতি সাহা ছোট থাকা অবস্থায় রাতে খাবার টেবিলে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, সংক্রামক রোগ প্রভৃতি নিয়ে কথা শুনতেন। খাওয়ার সময় এমন আলোচনা অনেকের নিকট উদ্ভট মনে হলেও তাদের পরিবারে এমনটাই হতো।
কারণ সেঁজুতির বাবা ড. সমীর সাহা মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। নিজের বিজ্ঞান বক্তৃতার অনুশীলন তিনি করতেন বাড়িতে খাবার টেবিলে। দেশের স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে যা জানতেন, তা নিয়েও কথা বলতেন।
সেসব আলাপ বড় ছাপ ফেলেছিল সেঁজুতির ওপর। পরে নিজেকে একজন অণুজীববিজ্ঞানী হিসেবে তিনি গড়ে তোলেন। ডা. সেঁজুতি সাহা তাঁর বাবার সঙ্গে এখন শিশুস্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ) একসঙ্গে কাজ করেন।
শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনতে তাঁর বাবা গড়ে উঠতে সহায়তা করেছেন প্রতিষ্ঠানটি। তাঁদের গবেষণা শুধু বাংলাদেশে নয়, একই রকম স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন অন্যান্য দেশেও কাজে লাগানো হচ্ছে।এখন বাবা-মেয়ে দুজনই বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতের প্রভাবশালী দুই ব্যক্তি।
শিশুমৃত্যু বেশি, এমন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সাথে সম্পদশালী দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবার দুরত্ব কমাতে কাজ করছেন তাঁরা। উপাত্ত, রোগ নির্ণয়ের সর্বাধুনিক পদ্ধতি এবং সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে তাঁরা টিকাদানকে কাজে লাগাচ্ছেন।
দরিদ্র দেশগুলোতে রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত হয় নবজাতক ও শিশুরা। রোগগুলো শনাক্তের সহজ উপায় খুঁজতে জোর দিয়েছেন সেঁজুতি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিশুদের মেনিনজাইটিসের সংক্রমণ বেড়ে যায়। কিন্তু ব্যাখ্যা মিলছিল না। সে সময় সেঁজুতি এর রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হন।
তিনি উদ্ভাবন করেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরের বিস্তারের কারণেই এর প্রকোপ বেড়েছে। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ছড়ায় মশার মাধ্যমে। রহস্য সবিস্তারে জানতে নমুনা বিশ্লেষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান তিনি। তখন বাংলাদেশে এ রোগনির্ণয়ে স্বল্পমূল্যের উপকরণ বের করেন তিনি, যাতে ভবিষ্যতে মেনিনজাইটিসসহ প্রাণঘাতী ব্যাধির বিস্তার দ্রুত মোকাবিলায় সহায়তা করা যায় দেশকে।
শিশুমৃত্যুর দুই ঘাতক ব্যাধি মেনিনজাইটিস ও নিউমোনিয়ার টিকা ব্যবহারে দেশকে সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সমীর সাহার। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ধনী দেশে টিকাগুলো সহজলভ্য হলেও বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশে সহজলভ্য ছিল না।
সিএইচআরএফের কাজের সুবাদে দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার অব্যাহতভাবে কমছে। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির আওতা ৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ড. সমীর ঢাকা শিশু হাসপাতালের অণুজীব বিভাগেরও প্রধান।
দুই রোগের টিকা চালু করার জন্য তাঁর তথ্য–উপাত্ত দারুণভাবে সহায়তা করেছে জনস্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকদের। হাজারো মৃত্যু প্রতিরোধ করেছে টিকা।
নিজেদের গবেষণার মাধ্যমে বাবা–মেয়ের সংগৃহীত তথ্য বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য অনেক সম্পদেরই ঘাটতি রয়েছে। নতুন টিকা তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হলেও দেশটির এখনো অনেক পথ যাওয়ার বাকি। চলতি বছর এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সেঁজুতি তাঁর গল্প শুনিয়েছেন। যে গল্পে বাংলাদেশে এখনো বড় স্বাস্থ্যগত নানা চ্যালেঞ্জের কথা রয়েছে। শিশুদের চিকিৎসায় সর্বাধিক সুবিধাসংবলিত হাসপাতাল ঢাকা শিশু হাসপাতাল।
সেখানে প্রতিবছর ভর্তি না হতে পেরে ছয় হাজারের বেশি শিশু ফিরে যায়। হাসপাতালটির ৬৬৫ শয্যা সব সময় রোগীতে পূর্ণ থাকে। শয্যার বেশির ভাগে এমন রোগীরা থাকে, যারা প্রতিরোধযোগ্য রোগে আক্রান্ত। অথচ হাসপাতাল থেকে এমন শিশু ফিরে যায়, যাদের জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ যদি রোগ প্রতিরোধে আরও কিছু করতে পারে, তাহলে প্রতিরোধ করা যায় এমন সব অসুস্থতার দিকে আরও মনোযোগ দিতে তার সম্পদ কাজে লাগাতে পারবে। সমীর ও সেঁজুতির কাজের কল্যাণে বাংলাদেশ এমন ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে, যেখানে সংক্রামক ব্যাধি কমবে। আর চিকিৎসার জন্য খালি থাকবে হাসপাতালের শয্যা।