যত দোষ সান্ধ্য কোর্স?

  © টিডিসি ফটো

১. সম্প্রতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সান্ধ্যকালীন কোর্স না রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতায়। ‘বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।’ সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ‘সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ করা বাঞ্ছনীয়’ ইত্যাদি নির্দেশ দিয়ে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সব সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করে দেয়া কি উচিৎ হবে?’

সান্ধ্যকোর্সের বিপক্ষে আছে প্রধানত বাম ঘরানারা শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রথম যুক্তি হচ্ছে, সান্ধ্যকোর্সের কারণে দিবাকোর্সের ক্ষতি হচ্ছে। শিক্ষকেরা ঠিকঠাকমতো ক্লাস নিচ্ছেন না। ফলপ্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে, সান্ধ্যকোর্সের বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। সান্ধ্যকোর্স পড়িয়ে শিক্ষকেরা ফোকটে টুপাইস কামিয়ে নিচ্ছেন।’

‘সান্ধ্যকোর্সের পক্ষে আছেন যে শিক্ষকেরা, তাঁরা বলছেন, অভিযোগগুলো মিথ্যা। প্রথমত, যেসব বিভাগে সান্ধ্যকোর্স নেই, সেসব বিভাগেই সাধারণত ফল প্রকাশে বিলম্ব হয়। দ্বিতীয়ত, একেক জন শিক্ষক একেকটা কোর্স থেকে প্রতি সেমিস্টারে (৬ মাসে এক সেমিস্টার) লাখ খানেক টাকা যদি পেয়ে থাকেন, তবে প্রতি মাসে পাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা। নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে, কোনো শিক্ষক বছরে সর্বোচ্চ তিনটি কোর্স পড়াতে পারবেন। শিক্ষকেরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ান, তবে তাঁরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াবেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ক্ষেত্রেও অবশ্য নিয়ম আছে: দুইটির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয় না।

২. সান্ধ্যকোর্সের বাণিজ্যিকীকরণের অভিযোগ অনেকটা ভর্তিপরীক্ষায় শিক্ষকদের আয়-সংক্রান্ত কুসংস্কারের মতো। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, ভর্তিপরীক্ষা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন। প্রকৃতপক্ষে যেসব শিক্ষক ভর্তিপরীক্ষার ডিউটি করেন, তাঁরা প্রতি পরীক্ষায় মাত্র ২ হাজার টাকা আয় করেন এবং পরীক্ষা হয় প্রতি বছর ৪/৫টি। যে অল্প কয়েকজন শিক্ষক ভর্তিপরীক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাঁরা কয়েক মাসের পরিশ্রমের বিনিময়ে লাখখানেক টাকা পেলেও পেতে পারেন।

একেক জন শিক্ষক প্রতি মাসে যদি নিজের যোগ্যতা ও শ্রমের বিনিময়ে দুটি কোর্স থেকে হাজার চল্লিশেক টাকা আয় করেন, সেটা কি খুব বেশি? প্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তিদের বিবিধ উপরি আয় ও গোপন দুর্নীতি থেকে প্রাপ্ত অর্থ কিংবা ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিপুল আয়ের সঙ্গে তুলনা করলে শিক্ষকদের এই আয় অকিঞ্চিৎকর। তদুপরি শিক্ষকদের এই আয় নিজেদের ঘর্মজাত এবং শতভাগ হালাল।

তৃতীয়ত, আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে, বাংলাদেশ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলেছিল, স্বনির্ভর হতে। স্বনির্ভর হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দুটি রাস্তা খোলা ছিল: ১. ছাত্রবেতন বৃদ্ধি করা এবং/অথবা ২. সান্ধ্যকালীন বা সপ্তাহান্তের কোর্স চালু করা।

ছাত্রবেতন বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়, কারণ তা করা হলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে তুলবে। তাদেরও যুক্তি আছে। জনকল্যাণকামী দেশে শিক্ষা কেন টাকা দিয়ে কিনতে হবে? জনগণকে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব সরকারের। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা অবশ্যই ‘নামমাত্র মূল্যে বিতরণ’ করতে হবে।

৩. অনন্যোপায় হয়ে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় রাস্তাটি বেছে নিয়েছিল, শুরু হয়েছিল সান্ধ্যকালীন কোর্স। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে কিংবা বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স নেই। যে সব বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে দূরে অবস্থিত, সেখানে সান্ধ্যকোর্স পড়ানোর সুযোগই নেই।

আঙ্গুরফল টক! যে শিক্ষকদের সান্ধ্যকোর্স পড়ানোর সুযোগ নেই, কিংবা যে সব শিক্ষক আর্থিকভাবে সচ্ছল, সান্ধ্যকোর্স পড়ানোর প্রয়োজন নেই, তারাই মূলত সান্ধ্যকোর্সের বিপক্ষে।

সান্ধ্যকোর্স পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের অন্যতম উৎস। সান্ধ্যকালীন কোর্স কিংবা কারিকুলামের অতিরিক্ত কোর্স থেকে যে আয় হয়, তার ৩০ শতাংশ যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে। কোর্স সমন্বয়কারী ৫ শতাংশ, ইনস্টিটিউটের পরিচালক কিংবা বিভাগের চেয়ারম্যান ৫ শতাংশ, কোর্স পরিচালনার জন্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পান ৫ শতাংশ, বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন খাতে যায় ১০ শতাংশ, এবং বাকি ৪৫ শতাংশ পান সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা। বিভাগ ও ইনস্টিটিউটভেদে এই হার সামান্য কমবেশি হতে পারে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওভারহেড ও উন্নয়নখাতে অর্থের পরিমাণ একই থাকে।

সুতরাং কোনো কোর্সে যদি ১ লক্ষ টাকা টিউশন ফি পাওয়া যায়, ৩০ হাজার টাকা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে, পরিচালক এবং কোর্স সমন্বয়কারী প্রত্যেকে পাঁচ হাজার টাকা করে পান, শিক্ষক পান ৪৫ হাজার টাকা। একেকটি কোর্স ভর্তি থেকে শুরু করে সার্টিফিকেট দেওয়া পর্যন্ত ৬ মাসের মতো লাগে এবং আগেই বলেছি, কোনো শিক্ষকই প্রতি শিক্ষাবর্ষে তিনটির বেশি কোর্স পড়াতে পারেন না নিজের বিভাগে বা ইনস্টিটিউটে। অনেক ক্ষেত্রে ৩টি কোর্স পড়ানোর মতো শিক্ষার্থী ভর্তিও হয় না।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলোর পরিচালনা ও উন্নয়ন ব্যয়ের মূল উৎস সান্ধ্যকোর্স থেকে প্রাপ্ত অর্থ। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের কথাই ধরা যাক। প্রতি মাসে ইনস্টিটিউটের পরিচালনা ও উন্নয়ন খাতে গড়ে লাখ তিনেক টাকার কম খরচ হয় না। ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠার বছর অর্থাৎ ১৯৭৪ সাল থেকে নতুন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সৃষ্টি করা হয়নি, কিন্তু গত ৪৫ বছরে একতলা ইনস্টিটিউট ৪ তলা হয়েছে। সুতরাং অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া অপরিহার্য এবং তাদের পারিশ্রমিক ইনস্টিটিউট থেকেই দেওয়া হয়।

প্রায় প্রতি সপ্তাহে সেমিনার, বিভিন্ন ভাষাপ্রোগ্রামের অনুষ্ঠান, প্রকাশনা, বিভিন্ন উৎসব, দুস্থ শিক্ষার্থীদের অর্থসাহায্য, লাইব্রেরির পুস্তক ও লিসেনিং সেন্টারের যন্ত্রপাতি ক্রয়, অতিথি আপ্যায়ন, বিভিন্ন সভা পরিচালনার খরচ, ইনস্টিটিউটের ভিতরে-বাইরে মেরামত-রঙ-কসমেটিক পরিবর্তন ইত্যাদিতে প্রচুর খরচ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়তো লাখ খানেক টাকা পাওয়া যায় প্রতি অর্থবছরে, যা দিয়ে ইনস্টিটিউট পরিচালনা করা অসম্ভব না হলেও কঠিন। তুমি সহ সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছি দিদি, টাকার যে অঙ্কগুলো বললাম, সেগুলো কমবেশি হতে পারে। চাঁদ দেখাচ্ছি, চাঁদের দিকে তাকাও, আমার আঙ্গুল মোটা কি চিকন সে বিচার করতে যেও না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দেওয়া যায় জীবনে মাত্র একবার। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না কিংবা যারা পছন্দমতো কোর্সে ভর্তি হতে পারে না, তাদের অনেকেই সান্ধ্যকোর্সে ভর্তি হয়। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল সান্ধ্যকালীন কোর্সের জন্যে। যারা সারাদিন কাজ করে তারা বিকালে বা সন্ধ্যায় ভাষা শিখতে আসে। আমরা কোন যুক্তিতে জনগণের কর্মরত অংশকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবো? একজন শিক্ষার্র্থী তার পছন্দমতো বিষয়ে সুযোগ না পেয়ে ধরা যাক, পালি ভাষায় ভর্তি হয়েছে। এই ছাত্র যদি বাজারে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে, এমন কোনো বিষয়, যেমন ব্যবসায় প্রশাসনে ভর্তি হতে চায়, তবে তাকে বাধা দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে? পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই যে কোনো শিক্ষার্থী একাধিক বিষয় পড়তে পারে।

৫. এমন অনেক বিষয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, যেমন অপরাধবিজ্ঞান, যোগাযোগ-বৈকল্য কিংবা দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা, যেগুলো কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্য যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য লক্ষ্য শিক্ষা নয়, মুনাফা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেফ সেই বিষয়গুলোই পড়ানো হয় বাজারে যেগুলোর তীব্র চাহিদা আছে। অথচ শিক্ষিত ও ওয়াকেবহাল সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বাজারে তেমন চাহিদা নেই- এমন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না।

পুলিশ বিভাগের কর্মরত একজন ব্যক্তি অপরাধ-বিজ্ঞানে একটি ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা নিতে চাইতেই পারেন। বিদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করতে ইচ্ছুক একজন সেনা কর্মকর্তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে লেখাপড়া করার ইচ্ছা কিংবা প্রয়োজন হতেই পারে। লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করতে ইচ্ছুক, এমন একজন ব্যক্তির কাছে পাঠাগার-ব্যবস্থাপনার ডিগ্রি অপরিহার্য হয়ে ওঠা অসম্ভব কি? একজন ডাক্তারের প্রয়োজন হতে পারে স্পিচথেরাপি বিষয়ে একটি ডিগ্রি নেবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সান্ধ্যকোর্সে এ ধরনের বহু বিচিত্র বিষয়ে পাঠ দেওয়া হয়। জনগণকে শিক্ষিত ও পেশাদার করে তোলার ক্ষেত্রে সান্ধ্যকোর্সের বিকল্প আপাতত নেই।

সবার জন্যে সব ধরনের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। যে যার পছন্দ ও প্রয়োজনমতো বিষয় বেছে নেবে। পাশ্চাত্যে যে কোনো বয়সের লোক তার পছন্দ ও প্রয়োজনমতো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পাঠ গ্রহণ করে। পাশ করে যারা একবার চলে যায়, তারাও জীবনের এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে।

জ্ঞান চিরপরিবর্তনশীল। আজ যা জানলাম, কালই তা ভুল প্রমাণিত হতে পারে। তথ্য ও বিশ্লেষণের দিক থেকে আপ-টু-ডেট থাকতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার বিকল্প নেই।

বাংলােদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু নাবালকদেরই প্রবেশাধিকার আছে। সাবালকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার দিতে রাষ্ট্র ও সমাজ রাজি নয়। নীতিনির্ধারকেরা যেহেতু কলেজ চেনেন, বিশ্ববিদ্যালয় চেনেন না, কলেজকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনাতেই তাঁরা অভ্যস্ত। কলেজের কাজ প্রধানত নাবালক পড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ প্রধানত সাবালক পড়ানো।

৬. সমাজের সাবালকেরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যেভাবে শিক্ষকদের ঋদ্ধ করতে সক্ষম, নাবালকদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। একজন শিক্ষকের সাধারণত শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকে। সান্ধ্য বা স্বল্পকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা জীবনের সাত ঘাটে বহু স্বাদের জল খাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিরে আসেন। তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিজেদেও জ্ঞান ঝালাই ও নবায়ন করে নেবার বহু সুযোগ থাকে। এই জ্ঞান দিবাকোর্সের শিক্ষার্থীদেরকেও ঋদ্ধ করার কথা। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে ‘বিশ্ব বিদ্যার আলয়’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সান্ধ্যকোর্সের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সান্ধ্যকোর্স জীবনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাড়িসূত্র। এই সূত্র ছিঁড়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র ছিন্ন হবে। বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ, জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষা পঙ্গু।

‘তবে একটা কথা। একজন শিক্ষকের স্বরতন্ত্রীর কম্পন-ক্ষমতারওতো একটা সীমা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এক বা একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুলটাইম, যদিও তারা কাগজে-কলমে অনুমতি নেয় পার্টটাইমের। পরকীয়ারত স্বামী বা স্ত্রীর মতো এরা কি নিজের পরিবারকে ফাঁকি দিচ্ছে না?’ এর উত্তরে বলা যায়: ‘ব্যতিক্রমতো থাকবেই । যারা আগুন খাবে, তারা আঙরা হাগবে। তাই বলে চোরের ভয়ে তুমি থালা বাদ দিয়ে মাটিতে ভাত খাবে?’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে কলেজের শিক্ষকের একটা বড় পার্থক্য আছে। আশা করা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক গবেষণা করবেন, জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন সাম্প্রতিক অগ্রগতি সম্পর্ক সমাজকে অবহিত করবেন, সমাজপতি ও রাষ্ট্রপরিচালকদের নিত্যনতুন ভুলত্রুটিগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে রাষ্ট্রপরিচালনায় ও সমাজের অগ্রগতিতে ভুমিকা রাখবেন।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি অর্থলোভে দিনরাত এখানে ওখানে পড়াতে থাকেন, তবে তাঁর পাঠদানের ক্ষমতা ও মানই শুধু কমবে না, তিনি একান্ত ব্যক্তিগত পড়াশোনা এবং গবেষণার জন্যে সময়ই বের করতে পারবেন না। শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, দিনে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা এবং ৮ ঘণ্টা ঘুমের সময় বাদ দিলে খুব বেশি হলে ১৬ ঘণ্টা তিনি পড়ানোর নামে ধান্দাবাজি করতে পারবেন। পরিবার ও নিজেকে কিছু সময় দেবার কথা না হয় বাদ দিলাম।

৭. জীবনে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য আনা কিংবা ভবিষ্যতে অধিকতর নিরাপত্তা পাবার উদ্দেশ্যে মানুষ মাত্রেই অধিকতর আয় করতে চায়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষকদের আদর্শ শিক্ষক মনে করার একটা সংস্কার বা কুসংস্কার বাংলাদেশে চালু আছে। সে যুগের শিক্ষকদের অধিকাংশ আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে পারতেন, কারণ সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের আর্থিক সঙ্গতির ব্যবস্থা করতো। অভাবে স্বভাব খারাপ হয়।

পঞ্চাশের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক, ধরা যাক, কাজী মোতাহার হোসেন মাসে ৩০০ টাকা বেতন পেতেন। এই টাকা দিয়ে তিনি ৬ ভরি স্বর্ণ কিনতে পারতেন। এখন একজন প্রভাষক, ধরা যাক, ৩০ হাজার টাকা বেতন পান। এই টাকা দিয়ে তিনি অর্ধভরি স্বর্ণ কিনতে পারেন। এর মানে কি? ৭০ বছর পর, যখন নাকি বাংলাদেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, তখন একজন প্রভাষককে প্রতি মাসে ১২ গুণ কম বেতন দেয়া হচ্ছে। যদি উপযুক্ত বেতন দেওয়া হতো, তবে একজন প্রভাষকের বেতন হতো ৩০ হাজার গুণ ১২ অর্থাৎ ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা বা ৪৫০০ ডলার, যা আমেরিকা-কানাডায় প্রভাষকের বেতনের অর্ধেকের চেয়ে কিছুটা বেশি।

এখন যেখানে ৮ম বেতন কাঠামো চলছে, সেখানে হয়তো ২০তম বেতন কাঠামো হওয়া উচিত ছিল। ইচ্ছে করেই হোক বা নিজের অজান্তেই হোক, রাষ্ট্র ১২টি বেতন কাঠামোর ট্রেন মিস করেছে। রাষ্ট্র ১২ গুণ ঠকিয়েছে ব্যক্তিকে, যদিও সরকার-প্রধান দাবি করেন এবং জনগণের একটি অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, বাংলাদেশে আহামরি বেতন দেওয়া হচ্ছে সবাইকে।

বাংলাদেশের সরকার বা প্রশাসন যাঁরা চালান তাদের ব্যয়ের তুলনায় আয় সীমাহীন বলে তাঁরা মনে করেন, দেশে কারও কোনো অর্থকষ্ট নেই। মন্ত্রী-আমলারা জনগণের টাকায় সর্বাধুনিক গাড়িতে চড়েন এবং এদিক ওদিক যাবার সময় তাদের বাবার রাস্তা খালি করে দেওয়া হয় বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা চমৎকার, কারও কোনো পথকষ্ট নেই। অসুস্থ হলে রাষ্ট্রপতি-শিল্পপতিরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারেন বলে তাঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, আমজনতাও তাঁদের মতো সুচিকিৎসা পাচ্ছে। পরের ধনে পোদ্দারী করলে যা হয় আর কী! ‘যত দিন ভবে না হবে, না হবে তোমার অবস্থা আমার সম। ইষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে, বুঝে না বুঝিবে যাতনা মম!’ যতদিন (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) দুর্ভাগ্যে-অপমানে আমাদের সমান তুমি না হবে, ততদিন তোমাকে বোঝায় কার সাধ্য! সাত মন তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না। হায়! তুমিও বাসে-ফুটপাতে চলবে না, মেডিকেলের আউটডোরে চিকিৎসা নেবে না, তোমার ছেলেমেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না, আমার দুঃখের রজনীও শেষ হবে না।

৮. আমার উচ্চমাধ্যমিক পাশ মাতামহ রেঙ্গুনে পোস্টমাস্টারের কাজ করে সংসার খরচ চালিয়ে একটা বাড়ি করে যেতে পেরেছিলেন চট্টগ্রামে নিজগ্রাম কুমিরায় (যেটি অবশ্য ১৯৭১ সালে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিল পাকবাহিনী)। নিজের পাঠ্য বিষয়ে বর্তমান পৃথিবীতে যত ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব ও উচিৎ সব আমার আছে। ৩০ বছর ধরে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করেও আমার নিজের (এবং আমার অনেক সহকর্মীর) একটি থাকার জায়গা কেন নেই, যখন কিনা আমাদের আমলা, বিচারক, সেনাকর্মকর্তা বন্ধুদের বেশির ভাগের, যারা প্রায় কেউই আমার বা আমাদের মতো ডিগ্রিধারী নন, নিজের বাড়ি কিংবা এ্যাপার্টমেন্ট আছে। উল্লেখ্য যে, আমার পিতামহ ছিলেন স্কুলমাস্টার এবং তিনিও কোনো বাড়ি করে যেতে পারেননি। একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইতিহাসের অবতারণা করার একমাত্র উদ্দেশ্য, এই একটি ব্যাপারে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যে শুভঙ্করের একটা ফাঁকি কোথাও না কোথাও আছেই।

পাশ্চাত্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সপ্তাহে ৬ ঘণ্টার বেশি পড়ান না। বছরে সর্বোচ্চ ৮ মাস পড়ান তিনি, কারণ তাঁর অন্য কাজ আছে- পড়াশোনা, গবেষণা, লেখালেখি আছে। শুনেছি, বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কম। একদিকে আমরা শিক্ষকদের প্রতিমাসে ১২ গুণ কম বেতন দিচ্ছি, অন্যদিকে অনন্যোপায় হয়ে কোনো কোনো শিক্ষক যখন কিছু অতিরিক্ত আয়ের ব্যবস্থা করছেন, তাকে আমরা নীতিহীন বলছি, যেন রাজনীতিবিদসহ বাংলাদেশের আর সব পেশার লোক একেকজন নীতির ধোয়া তুলসীপাতা। পঞ্চাশের দশকে এক জন প্রভাষক মাসের খরচ করেও বেতনের টাকা থেকে জমিয়ে ধানমণ্ডীতে জমি কিনতে পারতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষকের সংসারই চলবে না, যদি সে সান্ধ্যকোর্স কিংবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ায়।

রাষ্ট্র একবার শিক্ষকদের পাশ্চাত্যের মতো বেতন দিয়ে দেখুক, তারা অতিরিক্ত পড়ায় কিনা বা গবেষণায় মনোযোগী হয় কিনা। রাষ্ট্র শিক্ষককে শুধু নয়, সব পেশার লোককে ঠকাচ্ছে। শিক্ষক এখানে উদাহরণ মাত্র।

বাংলাদেশের পেটি দুর্নীতির অন্যতম উৎস আমার মতে প্রবঞ্চনামূলক বেতন-কাঠামো। বড় দুর্নীতি অবশ্যই দেশের ও সমাজের ক্ষতি করে, কিন্তু পেটি দুর্নীতি সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে দেয়। সব দেশে বড় দুর্নীতি আছে, কিন্তু সভ্য দেশে সাধারণত পেটি দুর্নীতি থাকে না। খুব কম সভ্য দেশেই পোস্টঅফিসের পিয়ন বকশিশের আশা করে!

৯. রাষ্ট্রের টাকা নেই- এ দাবি করা যাবে না। আজ থেকে দশ বছর আগেও এতগুলো ফোন-কোম্পানি থেকে এত কোটি কোটি টাকা কর পেতো না সরকার (জনগণের ও সরকারের অর্থ আত্মসাৎ করার অন্যতম হোতা এই ফোন কোম্পানিগুলো, কলড্রপ এবং করফাঁকি দেওয়া যাদের অন্যতম অস্ত্র!)। এক সময় আয়কর ছিল নামমাত্র। এখন আমি একজন সাধারণ শিক্ষক, আমি এ অর্থবছরে লাখ দেড়েক টাকার উপরে আয়কর দিয়েছি (হ্যাঁ, লুকানোর কী আছে? নাগরিক হিসেবে আয়কর দিয়েছি, বলবো এবং বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে সেবা আশা করবো!)। প্রতি বছর এক মাসের বেতনের বেশি চলে যায় আয়করে, আমার এবং হয়তো আমার মতো অনেক শিক্ষকের।

এই টাকা কোথায় যায়? এত টাকা সরকারের তহবিলে যে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে কোটি কোটি ডলার হ্যাক হয়ে গেলেও ব্যাংকের গভর্নর কিংবা সরকারের টনক নড়ে না। ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়ে গেলে যে রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী বলেন: ‘এটা কোনো টাকাই নয়!’ সে রাষ্ট্রের টাকা নেই- এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। রিজার্ভ যদি রাষ্ট্রের থাকে, তবে তা খরচ করতে হবে। ধন গোবরের মতো, খেতে ছড়িয়ে দিলে ফসল হয়, এক জায়গায় জমা করে রাখলে দুর্গন্ধ বের হয়। অপেশাদার ও অপরিণামদর্শী নীতিনির্ধারকেরা ব্যক্তিকে ঠকাচ্ছে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঠকছে পুরো সমাজ, ব্যাহত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন।

সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করার সপক্ষে বার বার ধুয়া তুলছে যে মহলটি সেটির অবস্থান মূলত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সপক্ষেই যায়। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যও প্রকারান্তরে সেই অবস্থানকে সমর্থন করছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের একটি মহলের অন্যতম লক্ষ্য, যেনতেন প্রকারের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নাম, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের নাড়ির সম্পর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতশ্রী হওয়ার অর্থ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হতশ্রী হওয়া। এটাই ঐ পক্ষের অন্যতম এজেন্ডা, জেনেশুনে বা অজ্ঞাতসারে। এর বিপরীতে তারা চায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তরিক্কি’ (তাদের অনেকের প্রাণের ভাষা উর্দুতেই বললাম)! ‘আইরনি’ বা কূটাভাস হচ্ছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য: শিক্ষা নয়, মুনাফা।

১০. সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি কি নিছক মুনাফাকেন্দ্রিক হতে পারে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে বিচিত্র বিষয়ে পাঠদানে সক্ষম কিংবা বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চার এই পড়ন্ত বিকালেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকের জ্ঞানের যে দীপ্তি ও পরিধি, অদূর ভবিষ্যতেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সেটা অর্জন করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে এবং থাকবে। সান্ধ্যকোর্সে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, সেগুলো না পড়ালেও হয়তো সমাজ এগিয়ে যাবে, কিন্তু সেটা আদর্শ সমাজ কিংবা বাঙালির কাম্য সমাজ হবে কিনা সে প্রশ্ন করাই যায়।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন না করতে পারার কারণটা ব্যক্তিগত নয়, প্রতিষ্ঠানগত ও পরিবেশগত। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকেরা সাধারণত, যতদূর দেখেছি, শুনেছি, সংস্কৃতিবান শিক্ষাবিদ নন, কাঠখোট্টা ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন। এটাও স্বাভাবিক, সংস্কৃতি চর্চার জন্যে যে অবসর দরকার তা ব্যবসায়ীদের থাকার কথা নয়। আমার এক ছাত্র বলতো: ‘লাঠি দিয়ে যার পেটানোর কথা, সেই পুলিশ কেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে!’ যে কোনো ব্যবসায়ীর মতোই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক-উপাচার্যেরা শিক্ষকদের শ্রমিক মনে করে দৌঁড়ের উপর রাখেন, চামচামী করতে বাধ্য করেন, অনেক সময় চাকরের মতো ব্যবহার করেন। এই পরিবেশ জ্ঞানচর্চার জন্যে অনুকূল নয়, বলা বাহুল্য।

তুলনীয়: দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ সাংসদ রাজনীতিবিদ নন, প্রাক্তন গুণ্ডা ও বর্তমানের ব্যবসায়ী। দক্ষিণ এশিয়ার অনুন্নতির প্রধান কারণ, গুণ্ডা ও ব্যবসায়ীদের কারণে রাজনীতিবিদেরা সংসদ পর্যন্ত আসতে পারেন না। এর পেছনে পরিবারতন্ত্রেরও হাত আছে, যদিও পরিবারতন্ত্রই একমাত্র কারণ নয়।

১১. একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম আলোচনার উজানে। সান্ধ্যকোর্স বিরোধী বামাচারীদের তৃতীয় যুক্তি হচ্ছে, সান্ধ্যকোর্সের গ্র্যাজুয়েটরা দিবাকোর্সের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে চাকুরির বাজারে। সান্ধ্যকোর্সের গ্র্যাজুয়েটদের বেশির ভাগ ইতোমধ্যেই চাকুরিরত। সুতরাং দিবাকোর্সের গ্র্যাজুয়েটদের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতার প্রশ্নই আসে না। এটা ঠিক যে চাকরির বাজার বিয়ের বাজারের মতো নয়। অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের দাম এখানে আনকোড়া নতুনদের চেয়ে বেশি। কিন্তু প্রতিযোগিতায় ভয় পেলে চলবে কেন? যারা সারাদিন চাকরি করেও একটা ডিগ্রি নেবার মতো পরিশ্রম করার ক্ষমতা রাখে, তাদের বাধা দিয়ে থামিয়ে রাখা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হলে তারা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়বে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে চাকরি পাবার দিন শেষ হয়ে এলো বলে। পাশ্চাত্যে চাকরির বাজারে ডিগ্রিকেও গুরুত্ব না দেবার রীতি শুরু হয়ে গেছে। কী পড়েছেন সেটা নয়, কী করতে পারেন কিংবা জানেন, নিয়োগকর্তারা সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

অভিবাসনপ্রবণ এই দেশে সান্ধ্যকোর্স বন্ধ করার প্রশ্নই উঠে না। জনগণকে শিক্ষিত করার কোনো বিকল্প নেই। কেন সাধারণ মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাবে না? প্রয়োজনে একাধিক শিফট, রাতের শিফট চালু করতে হবে। প্রয়োজনমতো শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। সান্ধ্যকোর্স ও দিবাকোর্সে আলাদা শিক্ষক নিয়োগ হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যশাখা থাকতে সমস্যা কী?

সাত কলেজ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন দিবাকোর্সের জন্যে মাছের মায়ের এই পুত্রশোক কোথায় ছিল? তখন না রাষ্ট্রপতি, না শিক্ষার্থীরা, কেউতো বলেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর এই লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর দায়িত্বের গুরুভার চাপিয়ে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। ‘সাত হাতি’ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামলাতে পেরেছে, তখন ‘সাতটি কাছি’ সংগ্রহের ঝামেলা কিংবা ‘বোঝার উপর শাকের আঁটি’ সান্ধ্যকোর্সও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামলাতে পারবে।

১২. বিশ্ববিদ্যালয় দিনরাত খোলা থাকলেই বা ক্ষতি কী? প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন কোর্স চালু করা এখন যুগের দাবি। সবার জন্যে শিক্ষা! শিক্ষাসংকোচন কোনমতেই কাম্য নয়, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এই বাস্তবতাটা বুঝতে হবে। সান্ধ্যকোর্সের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়। নাবালক এবং সাবালক, উভয় শ্রেণীর মানুষের বিচরণ থাকতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সান্ধ্যকোর্স না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ ও বাজারের সঙ্গে সম্বন্ধহীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, সান্ধ্যকোর্স সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে, প্রথমত, সান্ধ্যকোর্সের বাণিজ্যিক ব্যবহার (যদি হয়ে থাকে) এবং দ্বিতীয়ত, সান্ধ্যকোর্সের কারণে দিবাকোর্সের প্রতি অবহেলা (যদি হয়ে থাকে)। ঘাড়-ব্যথার জন্যে মাথা কেটে ফেলা উচিৎ হবে না।

সান্ধ্যকোর্স কি আজকের দাবি? ঊনসত্তর সাল থেকে শিক্ষার্থীরা সান্ধ্যকোর্সের দাবি করে আসছেন। সান্ধ্যকোর্সের দাবি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকা মারার কথা এখনও স্মরণ করতে পারেন অনেকে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির মনে পড়তেও পারে। আজ এত বছর পর, শিক্ষার্থীরা এবং সমাজের একটি অংশ সান্ধ্যকোর্সের বিরুদ্ধে সোচ্চার কেন? শিক্ষকেরা সান্ধ্যকোর্স পড়িয়ে অল্পবিস্তর টাকা পাচ্ছেন বলে? আচ্ছা, নিলাম না টাকা! এর পরেও কি আপনারা সান্ধ্যকোর্সের বিপক্ষে থাকবেন? যদি না থাকেন, তবে বলুন, একজন শিক্ষককে বিনা পয়সায় কলুর বলদ বানানোর অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? এমত রুচিই বা আপনার হলো কী করে? আপনি নিজে কি বিনা পয়সায় কুটোটিও নাড়েন? অবশ্যই নাড়েন না, যা পাওয়া উচিত, তার দশগুন আপনি পান, নইলে আপনার বাড়ি-গাড়ি হয়, শিক্ষকদের হয় না কেন?

১৩. ’৭৩-এর অধ্যাদেশ। বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে গত পঞ্চাশ বছরে। নতুন যুগের নতুন প্রয়োজন অনুসারে সিনেটে-সিন্ডিকেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শতবর্ষ পূর্তিকে সামনে রেখে এই অধ্যাদেশে পরিবর্তন-পরিবর্ধন-সংযোজন করার বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। সেই আলোচনার নির্ধারিত হওয়া উচিত, সান্ধ্যকোর্স থাকবে কি থাকবে না, বাঙালির মতো অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত একটি জাতির পক্ষে বিকালে ও রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার বিলাসিতা আদৌ গ্রহণযোগ্য কিনা ইত্যাদি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন মরুঝড়ে বিপর্যস্ত উটের মতো বালিতে মুখ না গুঁজে পড়ে না থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ পরিবর্তন এবং অধ্যাদেশ না থাকলে যুগোপযোগী অধ্যাদেশ প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। ‘সভ্যতার প্রথম শর্তই হচ্ছে আইন প্রণয়ণ!’ (সেই আইন কেউ মানুক বা না মানুক!)। ‘দি ব্রিজ অন দি রিভার কাওয়াই’ ছবির সংলাপ।

নদীমাতৃক ও জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাংলাদেশ জায়গাটা কখনই অশ্ব কিংবা অশ্বতরের বাসের উপযুক্ত ছিল না। কিন্তু ‘মুখের লাগাম’ বলে একটা কথা অদ্যাবধি বাংলা শব্দকোষের অংশ হয়ে আছে কেন? সর্বোচ্চ থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পদস্থ পর্যন্ত বাঙালি মাত্রেরই স্বভাবগত, অচিন্তিত ও ফসকানো মুখ বাকচাপল্যই এর কারণ কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। চুঙায় না রেখেও লেজ সোজা যে হতে পারে তার আলোকচৈত্রিক প্রমাণ সংযোজিত হলো, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট


সর্বশেষ সংবাদ