রাষ্ট্র কীভাবে ব্যক্তিকে ঠকাচ্ছে এবং নিজে ঠকছে?

  © টিডিসি ফটো

পঞ্চাশের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক, ধরা যাক, কাজী মোতাহার হোসেন মাসে ৩০০ টাকা বেতন পেতেন। এই টাকা দিয়ে তিনি ৬ ভরি স্বর্ণ কিনতে পারতেন। এখন একজন প্রভাষক, ধরা যাক, ৩০,০০০ টাকা বেতন পান। এই টাকা দিয়ে তিনি অর্ধভরি স্বর্ণ কিনতে পারেন। এর মানে কি? ৭০ বছর পর, যখন দেশ নাকি উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, তখন একজন প্রভাষককে প্রতি মাসে ১২ গুণ কম বেতন দেয়া হচ্ছে। আসল কথা হচ্ছে, ১২গুণ ঠকানো হচ্ছে।

পঞ্চাশের দশকে অক্সফোর্ডের শিক্ষক আর ঢাকার শিক্ষক প্রায় একই পরিমান বেতন পেতেন বলে শুনেছি। এখন একজন প্রভাষকের বেতন হওয়া উচিত ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ডলার। এ বেতন আমেরিকা-কানাডার প্রভাষকের বেতনের প্রায় অর্ধেকের কিছু বেশি।

যাই হোক, সে যুগে এক জন প্রভাষক মাসের খরচ করেও বেতনের টাকা থেকে জমিয়ে ধানমণ্ডিতে জমি কিনতে পারতেন। এখন একজন প্রভাষকের সংসারই চলবে না, যদি সে সান্ধ্যকোর্স কিংবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ায়।

পাশ্চাত্যে দেখেছি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সপ্তাহে ৬ ঘণ্টার বেশি পড়ান না। বছরে সর্বোচ্চ ৮ মাস পড়ান তিনি, কারণ তাঁর অন্য কাজ আছে, পড়াশোনা, গবেষণা, লেখালেখি আছে। শুনেছি, বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কম। একদিকে আমরা শিক্ষকদের প্রতিমাসে ১২ গুণ কম বেতন দিচ্ছি, অন্যদিকে অনন্যোপায় হয়ে কোনো কোনো শিক্ষক যখন কিছু অতিরিক্ত আয়ের ব্যবস্থা করছেন, তাকে আমরা নীতিহীন বলছি, যেন রাজনীতিবিদসহ বাংলাদেশের আর সব পেশার লোক একেকজন নীতির ধোয়া তুলসীপাতা। শিক্ষককে শুধু নয়, আমরা সব পেশার লোককে ঠকাচ্ছি। শিক্ষক এখানে উদাহরণ মাত্র।

উপযুক্ত বেতন পেলে ব্যক্তি উপযুক্ত খাবার-পোশাক পেতো, লেখাপড়া ও গবেষণায় মন দিতে পারতো, যেতে পারতো ছুটিতে, কনফারেন্সে। উত্তর পুরুষ সুষম খাদ্য খেয়ে বড়ো হতো। মা-বাবাকে ধান্ধার পেছনে ছুটতে হতো না বলে তারা সন্তানকে অধিক সময় দিতে পারতো। আচ্ছা, বেতন যদি ১২ গুণ বেশি হয়, তবে চালের কেজি ১০০ টাকা হলেই বা কী! চালের দাম বেশি হলে কৃষক কিংবা কৃষিখাত কি অধিকতর উপকৃত হয় না? পর্যটন, শিল্প থেকে শুরু করে সব খাতেরই কি উন্নয়ন হয় না? তাছাড়া আয় বেশি হলে, আয়করও বেশি হবে। সরকারের টাকা সরকারের কাছেই ফেরৎ আসবে, মাঝে দশ হাত ঘুরে পুঁজির পরিমাণ যাবে বেড়ে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাসহ সমাজের সর্বস্তরের উন্নয়ন পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ সম্ভবত এর প্রবঞ্চনামূলক বেতন কাঠামো।এটা সমাজের সর্বব্যাপী দুর্নী‍তিরও অন্যতম উত্‌স এবং বলা বাহুল্য দুর্নীতি থেকে আয়কর আসে না, বেতন থেকে আসে। ‘সম্ভবত’ বললাম এ কারণে যে আমি অর্থনীতির প্রাক্তন ছাত্র হলেও বিশেষজ্ঞ নই। উপরি আয় নেই বলে আজ একজন যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের চাকুরি ছেড়ে কাস্টমসের চাকুরিতে যোগ দেয়। উপযুক্ত বেতন দেয়া হলে, প্রতিভাবানেরা নতজানু পরিবেশে প্রশাসনিক ক্যাডারের ফালতু কাজে তাদের প্রতিভা ও জীবন নষ্ট না করে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদ্যার্জনে ও বিদ্যাদানে মনোনিবেশ করতে পারতো।

রিজার্ভ যদি রাষ্ট্রের থাকে, তবে তা খরচ করতে হবে। ধন গোবরের মতো, খেতে ছড়িয়ে দিলে ফসল হয়, এক জায়গায় জমা করে রাখলে দুর্গন্ধ বের হয়। অপেশাদার ও অপরিণামদর্শী নীতিনির্ধারকেরা ব্যক্তিকে ঠকাচ্ছে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঠকছে পুরো সমাজ, ব্যহত হচ্ছে দেশের উন্নয়ন।

শিশির ভট্টাচার্য্য-এর ফেসুবক থেকে নেয়া।


সর্বশেষ সংবাদ