নাগরিকত্ব সংশোধন বিল ও ভারতীয় ধর্ম নিরপেক্ষতা
ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা ক্যাব ঘিরে প্রবল মত বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। এই মতবিরোধ থেকেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে আসাম। অসন্তোষ দমানোর জন্য ভারত সরকার এই অঞ্চলে জারি করেছে কারফিউ। আসাম রাজ্যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন।
নিরাপত্তা রক্ষার্থে উড়োজাহাজ ও ট্রেন চলাচল এখানে বন্ধ করা হয়েছে। ছাত্রদের আহুত এই আন্দোলনে অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আসু একত্রিত হয়েছে। কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতিসহ সাধারণ মানুষের উপস্থিতি এখানে লক্ষণীয়। বিজেপি প্রস্তাবিত এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্থানের যেসব অমুসলমান নাগরিক ‘ধর্মীয় অত্যাচার ও নির্যাতন’ সইতে না পেরে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
তারা আর চিহ্নিত হবেন না ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে। কিন্তু, মুসলমানরা চিহ্নিত হবে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে। বিরোধের সূত্রপাত তো এই জায়গা থেকে। বিজেপি ও অমিত শাহের এই দ্বিচারিতাকে মুসলমানগণ ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। যে বিজেপির পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সমাজসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তার কার্যক্রম তো এরকম হবেই।
তারা তো চায়, ‘এক রাষ্ট্র, এক ধর্ম এবং এক ভাষা’ প্রতিষ্ঠা করতে। নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর বিজেপি তার বাকী হিন্দুত্ববাদী কাজগুলোকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য সর্ব শক্তি দিয়ে কাজ করছেন। নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের কথায় অমিত শাহ বার বার উদাহরণ টেনেছেন নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির।
অমিত শাহ বলছেন, নেহেরু ও কংগ্রেসের এই চুক্তির কারণে নাকি আজকের এই সংশোধন বিলের অবতারণা করতে হয়েছে বিজেপিকে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সংখ্যালঘুদের অবস্থা এবং প্রভূত পরিমাণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিলক্ষিত হয় এবং এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য এই চুক্তির প্রয়োজন হয়।
১৯৫০ সালে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশে) এর ১০ লাখেরও বেশি হিন্দু ও মুসলমান উদ্বাস্তু হন। লিয়াকত নেহেরু চুক্তির শুরুতেই বলা হয়েছিল যে, ‘ভারত ও পাকিস্তানের সরকার উভয়েই নিজেদের এলাকায় সংখ্যালঘুদের ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকত্বে সমমর্যাদা, জীবন, সংস্কৃতি, সম্পত্তি এবং আইন মোতাবেক ব্যক্তিগত সমান ও নিজ দেশে চলাফেরা, পেশা, বক্তব্য ও অর্চনার স্বাধীনতা দিতে সম্মত হয়েছে।’
কিন্তু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, ওই চুক্তি অনুসারে ভারত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিলেও পাকিস্তান তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ভুলের সংশোধন হবে ক্যাবের মাধ্যমে। কিন্তু, বাস্তবতা তো এখন অন্য কিছু বলছে। ভুল সংশোধন না করে বরং অমিত-মোদীরা ভুল আরো বেশি করছেন। কেননা, এই সংশোধন বিলকে কেন্দ্র করে ভারতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছে, যার বলি হয়েছে বৃহস্পতিবার আসামে দুইজন ব্যক্তি।
ভারত হারাচ্ছে তার ধর্মানিরপেক্ষ চরিত্র। মহাত্মা গান্ধীর ভারত সারাবিশ্বে অনন্য উচ্চতায় গিয়েছিল শুধু তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য। ভারতের সংবিধানে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাযুক্ত হয়। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারমালার মধ্যে ব্যক্তি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংবিধানের ১৫ ধারা অনুযায়ী ধর্মের কারণে রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক নাগরিকেরই নিজের ধর্ম ঘোষণা, আচরণের প্রচার করবার সমান অধিকার আছে। ২৬ ধারায় আরও বলা হয়েছে যে, প্রতিটি নামধারী ধর্মগোষ্ঠীরই অধিকার আছে স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনা করবার।
তবে, আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সমর্থিত বিজেপি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই ভারত হারিয়েছে তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে বিজেপির নেতৃত্বে ৪৬৪ বছরের স্মৃতিবাহী বাবরি মসজিদ ভাঙ্গন কান্ড থেকে শুরু করে বর্তমানের এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধন বিল এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার সকল কিছুই এর বড় উদাহরণ।
বিজেপি সরকারের এসকল কাজ শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা হরণ করছে তা নয় একইসাথে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিচ্ছে। ভারতের এই কার্যক্রমগুলোতে পুরো নাখোশ তার পাশ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলো। খোদ, বাংরাদেশের মত ভারতের পরিক্ষিত বন্ধুও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে এখন।
বিভিন্ন বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে যে, ভারত-বাংলাদেশ সুসর্ম্পক ধরে রাখতে পারছে না ভারত নিজেই তার এই দ্বিচারিতার কারণে। নাগরিকত্ব সংশোধন বিল যেমন চিন্তায় ফেলে দিয়েছে ভারতীয়দের, তেমনিভাবে পাশ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলমানগণ ভাবতে শুরু করেছে।
যত দ্রুত অমিত-মোদীর বিজেপির ভারত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধরে রাখার চেষ্টা শুরু করবে ততই দ্রুত ভারত স্থিতিশীল হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের মোড়ল মার্কিনীরাও বিজেপির এই নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে সন্তুষ্ট নন। এ কারণে মার্কিন কমিশন অমিত শাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ জানিয়েছে। আশা থাকবে, ভারত দ্রুত তার বোধোদয় ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ধরে রাখার জন্য জনসমর্থিত কাজ শুরু করবে।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা