আবেদনহীন সংবিধান দিবস
আজ সংবিধান দিবস। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর প্রণীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। গত ৪৭ বছরে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে ১৭ বার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে এই সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।‘রাষ্ট্রের মালিক জনগণ’ - একথা সংবিধানে লেখা আছে সত্য। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সম্পুর্নভাবে এক ব্যাক্তির অধীনে চলে গেছে! এক ব্যক্তির ইচ্ছার অধীনে চলে যায় বলেই, সংবিধানের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হয়।
এক ব্যাক্তির ইচ্ছার অধীনে চলে যায় বলেই, অনেকগুলো আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক নির্দেশনা আজও কার্যকর করা হয়নি! উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনার নিয়োগ, ন্যায়পাল নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে আজও কোন আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এক ব্যক্তির ইচ্ছাধীন নীতিমালা দিয়েই এগুলো চলছে।
সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগের কথা লেখা আছে। কিন্তু বাস্তবে বিচার বিভাগের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে দাপ্তরিক কাজ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আর কোনো ক্ষমতাই নেই।
কত রকমের অধিকার, কত রকমের সুরক্ষা, কত মালিকানা, কত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে জনগণকে এই সংবিধানে। অথচ বাস্তবে জনগণের সব ক্ষমতা ও মালিকানা তো এক ব্যক্তির হাতেই! পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট মাত্র ১৭ পাতার সংবিধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। অথচ ১৭৭৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের সংবিধানে মাত্র ২৭টি সংশোধনী হয়েছে। আর আমরা সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে নিজের মতো করে লিখে চলেছি। কেউ আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য! কেউ আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ১৭৩ দিন হরতাল করে। তিনিই আবার মিডনাইট ইলেকশনের জন্য সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটাই বাতিল করে দিয়েছেন।
সংবিধানের মূল চেতনাগত জনগণের প্রত্যক্ষ নির্বাচনকে ক্ষুন্ন করে বিনাভোটে ক্ষমতা দখল করে নেয়া হলো। একইভাবে পাঁচ বছর পর মিডনাইট নির্বাচনেও জনগণের ভোটাধিকারকে নির্লজ্জভাবে হরণ করা হলো। ঠিক যেমনটা ৭৫ সালের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে নির্বাচন ছাড়াই তিনশ আসনে পাঁচ বছরের জন্য এমপি করা হয়েছিল। এ এক আশ্চর্যজনক সাংবিধানিক তামাশা! সংবিধানের দোহাই দিয়েই সাংবিধানিক তামাশা!
সংবিধানের মেরুদণ্ড ভেঙে পঞ্চদশ সংশোধনী করে ৫৩টি অনুচ্ছেদ চিরকালের জন্য সংশোধন অযোগ্য করা হলো। সংবিধানকে রক্তাক্ত করে একনায়িকাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হলো। সেটাকে আবার চিরকালের মতো সংশোধনের অযোগ্য করে দেয়া হলো। কেউ যদি এই বিধানকে সংশোধন করতে চায় তার মৃত্যুদণ্ডের বিধানও করে রাখা হলো। অথচ তিনিই আবার একের পর এক সংবিধান লংঘনের গুরুতর অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ শাসন করছেন। আর আশ্চর্যজনকভাবে, এটাও করা হচ্ছে খোদ সংবিধানের দোহাই দিয়েই।
সংবিধানের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সকে ধ্বংস করে দেয়া হলো। সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকে বাদ দেয়া হলো আদিবাসীদের। গণভোট বিলুপ্ত করা হলো। তত্ত্বাবধায়ক বাদ দিয়ে একনায়িকার স্বৈরশাসন তৈরি করা হলো। সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ ক্ষমতা খর্ব করা হলো। ১৬ কোটি মানুষের অভিপ্রায়ের এই সংবিধানকে এক ব্যক্তির অভিপ্রায়ের কাছে করুণভাবে পরাস্ত করা হলো। সংবিধানকে আওয়ামী লীগের দলীয় হ্যান্ডবুকে পরিণত করা হলো। ১৬ কোটি মানুষের সংবিধানকে এক ব্যক্তির ইচ্ছার অধীনে ন্যস্ত করা হলো।
আদি গ্রিক সমাজে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। সেখানে দাসদের কোনো অধিকার ছিল না। দাসদের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করারও কোন অধিকার ছিল না। একথা তাদের সংবিধানেও ছিল। আমাদের সংবিধানে দাসত্ব নেই। বরং সংবিধানে রাষ্ট্রের মালিকানা দেয়া হয়েছে জনগণকে। অথচ বাস্তবে আমরা কিন্তু সেই আদি গ্রিক সমাজের দাসদের মতই রাজার মালিকানাধীন। সংবিধানের কাগজে কলমে আমরা মালিক। কিন্তু বাস্তবে আমরা আদিম সমাজের দাসদের মতই ক্ষমতাহীন। আর এই কারণেই এখন আর সংবিধান নিয়ে জনগণের তেমন কোন আগ্রহ নেই। জনগণের কাছে সংবিধান দিবস তাই আজ এতটাই আবেদনহীন।
লেখক: আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।