ক্রিকেটারদের দাবি পূরণ বনাম শিক্ষকদের লাঠিপেটা
ক্রিকেটাররা বহিঃর্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন, দেশের মানুষকে আনন্দ দেন বলেই তাঁরা আজ সেলিব্রেটি, অনেকেই তাঁদের জাতীয় বীর হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। তাঁদের পেশাগত দাবী-দাওয়া পূরণে অবস্থান গ্রহণ, পরবর্তীতে সরকারের নির্দেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বোর্ড কর্তৃক দাবী পূরণেও কোন দোষ দেখি না। এটা নিঃসন্দেহে ভালো একটি দৃষ্টান্ত।
কিন্তু ভীষণভাবে লজ্জিত, ব্যথিত ও বিস্মিত হই যখন দেখি জাতি গঠনের মূল কারিগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবী আদায়ে একত্রিত হওয়ার অপরাধে লাঠিপেটা করা হয়! যুগের পর যুগ ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই শিক্ষকদের ছোট করে রাখার চেষ্টা করা হয়! হেয় বা অসম্মান করা হয়! অথচ তাঁদেরইতো জাতীয় বীর হিসেবে সম্মান পাবার কথা ছিল?
যারা শত অপমান ও বঞ্চনা সহ্য করেও হাসিমুখে আপনার-আমার সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু হয়েছে তার বিপরীত!
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকেরা ১৪তম গ্রেডে ও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকেরা ১৫তম গ্রেডে বেতন পান। আর প্রশিক্ষণ পাওয়া প্রধান শিক্ষকেরা ১১তম গ্রেডে এবং প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষকেরা ১২তম গ্রেডে বেতন পান। হায়রে পোড়া কপাল! যাদের জাতি গড়ার দায়িত্ব সঁপেছি, তাঁদের যে রাষ্ট্রীয়ভাবে ৩য় শ্রেণীর কর্মচারী বানিয়ে রেখেছি!
ফলশ্রুতিতে দুটি কাজ কিন্তু ভালোমতোই হচ্ছে, ক). প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকতায় মেধাবীরা চরমভাবে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন (অপ্রিয় হলেও প্রচলিত আছে যে বর্তমানে যারা অন্য কোন চাকুরি পাননা অথবা গৃহিণীর গুরু দায়িত্ব সামলানোর অবসরে পাওয়া সময়টাকে কাজে লাগাতে চান তাঁরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হন ! তবে আমি বিশ্বাস করি এখনো শিক্ষকতাকে মন থেকে ধারণ করে অনেক মহান ব্যক্তি এই পেশায় আসছেন)।
খ). নৈতিক, মানবিক ও যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জাতি। প্রতিনিয়ত অসম্মানের মধ্য দিয়ে যাওয়া, হীনমন্যতায় ভোগা শিক্ষকবৃন্দের কাছে জাতি এরচেয়ে বেশি কী আশা করে? মনে রাখতে হবে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন মেধাবী, আত্নবিশ্বাসী ও আত্নসম্মানে বলীয়ান শিক্ষকবৃন্দই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি উপহার দিতে পারে। আর এজন্য শুধু মুখে মুখে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্মান না, অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
প্রাথমিকসহ সকল স্তরের শিক্ষকদের ১ম শ্রেণীর পদমর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই মেধাবীদের পছন্দের তালিকায় শিক্ষকতা যুক্ত হবে, এতে করে দ্রুতই শিক্ষার মানও বাড়বে, নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের স্বচ্ছতার জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে।
অথবা NTRAC (Non-Government Teachers' Registration & Certification Authority)-কে BTRA (Bangladesh Teachers' Recruitment Authority)-তে রুপান্তর করে আরো বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী করা যেতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঈর্ষনীয় হলেও আমাদের জাতিগত নৈতিকতা বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ও চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাঙ্গনে পরপর ঘটে যাওয়া বিষয়াদি সেটারই ইঙ্গিতই বহন করে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার, তবে সত্য বলতে কি মাঝে মধ্যে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানে সাময়িকভাবে কিছু ফলাফল আসলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
একটি শুদ্ধজাতি গঠনে হাত দিতে হবে গোড়ায় বা মূলে, বিনিয়োগটাও করতে হবে সেখানেই, সেটা শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সিংহভাগই বরাদ্দ হোক শিক্ষা ও মানব সম্পদ উন্নয়নে। যেকোন উপায়েই হোক শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৫.৫% বরাদ্দ খুব জরুরি। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করুন, সুযোগ সুবিধা দিন, নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করেন।
দেখবেন আজ না হোক ১০ বছর বা ২০ বছর পর থেকে এই সুফল জাতি পেতে শুরু করবে। সোনার মানুষ গড়তে পারলে দূর্নীতি বিরোধী অভিযানের কি আর প্রয়োজন পড়বে?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়