বৈষম্যমূলক বেতনকাঠামো প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে অন্যতম বাধা
শিক্ষা প্রতিটি নাগরিকের জন্মগত অধিকার। যার কারণে প্রতিটি মানুষের শিক্ষা অর্জন করতে হয়। আর শিক্ষা প্রদানে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে শিক্ষকেরা আরো খোলশা করে বললে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। শিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে মান সম্মত শিক্ষক প্রয়োজন। মান সম্মত শিক্ষক ছাড়া কোন জাতির কাঙ্খিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে ‘Morning shows the day'। প্রবাদের সাথে তাল মিলিয়ে বলতে হয় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুন্দরভাবে না সাজিয়ে উচ্চ শিক্ষা বিস্তার কিংবা দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি কখনও সম্ভব নয়। শিক্ষকরা দেশ গড়ার কারিগর। আর সেই গড়ার কারিগরে প্রথম সারিতে থাকার কথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। কিন্তু প্রকৃত বিচার বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যায় বাস্তব চিত্র ঠিক উল্টো কথা বলে। সমাজের অন্য পেশাজীবী থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সবচেয়ে বেশী বৈষম্যের শিকার, তারাই বেশী অবহেলিত।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা ছাড়া আরো কত কিছু করতে হয়। শিক্ষকরা শুধু শিক্ষকতা পেশায় থাকে না এর পাশাপাশি আরো নানা ধরনের কাজ করতে হয় কিন্তু অন্য পেশাজীবীদের এমনটা তেমন ঘটে না। শিক্ষকরা যদি শুধু তাদের পেশায় থাকতো তাহলে শিক্ষকেরা আরো সুন্দর ও সুচারুভাবে তাদের পেশায় মনোনিবেশ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে পারতো। আর এটা সঠিকভাবে করতে পারেলেই কেবল দেশ আরো আগেই উন্নতির ছোঁয়া পেতে পারতো বলে আমার কাছে মনে হয়।
আমাদের সবারই জানা থাকা উচিৎ প্রতিটি মানুষের চলার পথে এবং সঠিক জীবনযাপন করতে হলে যে বিষয়টা সবার আগে সামনে প্রতীয়মান হয় তা হলো আর্থিক বিষয় ও সামাজিক মর্যাদা। সবাই মুখে মুখে আমাদের শিক্ষকদের মান মর্যাদা প্রদান করে থাকে। সবাই বলে শিক্ষকতা মহান পেশা। আমি নিজেও তা অকপটে স্বীকার করি এবং মানসপাঠে তা ধারণও করে থাকি। শিক্ষকতা করার পাশাপাশি প্রতিটি শিক্ষকদের একটা পারিবারিক জীবন থাকে যেখানে মর্যাদা থেকে আর্থিক বিষয়টা বেশী জরুরি। যার জন্য শিক্ষকদের বেতনের বৈষম্য কমানো উচিৎ। বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে অনেক মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চায় না। মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হলে যে সব বৈষম্য আছে তা দূর করতে হবে। মেধাবীরা যদি এই পেশায় না আসে তাহলে দেশের কাঙ্খিত উন্নতি অসম্ভব বলে আমার ধারনা।নামমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি কিন্তু প্রকৃত বিচারে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় রেখে কখনও একটা দক্ষ ও মেধাবী সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
২০১৪ সালে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ঘোষনা দিয়েছিলেন যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পাবে তখন সব শিক্ষকেরা মহাখুশি হয়েছিল এই কারণে যে তাদের মর্যাদা কিছুটা বৃদ্ধি পাবে এই আশায়। বিষয়টা আরো বড় আকার ধারণ করে যখন ৩৪ তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা হয় তখন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয় ৫ বছর পার হলেও তা আশার আলো দেখেনি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। জানামতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা বলেই ৩৪ তম ও ৩৬ তম বিসিএস থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নন-ক্যাডার নিয়োগ শুরু হয়। যা বর্তমান গ্রেড অনুসারে ১২ তম গ্রেডের আওতায় পড়ে। কিন্তু পিএসসির সুপারিশ করা অন্যান্য পদের ২য় শ্রেণির পেশায় যারা আছেন তা ১০ম গ্রেডে বেতন পান। যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সাথে চরম বৈষম্য।
শিক্ষকদের নিম্ন সামাজিক মর্যাদা কিংবা আর্থিকভাবে অসচ্ছল রেখে কখনও শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিকল্পে যে কাজটা জরুরি তা হলো শিক্ষকদের বেতন গ্রেডের বৈষম্য কমানো। মনে ব্যাথা বা চাপা কষ্ট বা ক্ষোভ রেখে প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করা অসম্ভব। পেশাগত জীবনে অল্পকিছু হলেও পাঠদান বিষয়ে আরো আগে থেকেই ধারণা ছিল। প্রতিটি শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাই সরকারের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ যে প্রাথমিক শিক্ষায় জড়িত সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারি সবার বেতন বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি দ্রুত পদোন্নতি ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। আর এটা করতে পারলেই কেবল এই শিক্ষার মান বাড়বে অন্যথায় এটা সম্ভব নয়। তাই অবিলম্বে এটি কার্যকর করা উচিৎ।
লেখক: তৌহিদুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক (৩৬ তম বিসিএস নন-ক্যাডার)
১০১ নং পূর্ব তেঁতুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝিনাইদহ সদর, ঝিনাইদহ