২০ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:২৫

উপাচার্যের চেয়ে যুবলীগ চেয়ারম্যানের পদ বড়?

সংবাদটি চোখে পড়ার পর একটু থতমত খাই। ভেবেছিলাম এটা বোধহয় রসিকতা কিংবা কোনো ভুঁইফোঁড় অনলাইন নিউজ পোর্টালের কারসাজি। পরে দেখা গেলো, দেশের শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোও খবরটি প্রকাশ করেছে যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান- যিনি এর আগে ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন; তিনি বলেছেন, যুবলীগের দায়িত্ব পেলে তিনি উপাচার্য পদ ছেড়ে দিতে রাজি আছেন।

প্রশ্ন হলো তিনি কি কথাটি জেনেশুনে বলেছেন? বোধ হয় জেনেবুঝেই বলেছেন। কারণ খোঁজ নিয়ে জানা গেলো- তিনি আসলে যুবলীগেরই কর্মী এবং সম্ভবত যুবলীগের কোটায়ই তিনি ভিসি হয়েছেন। জানা যাচ্ছে, ড. মীজান ২০০৩ সাল থেকে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার এবং ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক যখন পলাতক, তখন মিজানুর রহমান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। অর্থাৎ বিষয়টি নতুন নয়। তিনি মূলত যুবলীগ নেতা। শিক্ষক অথবা উপাচার্য তার দ্বিতীয় পরিচয়।

‘উপাচার্য না যুবলীগ চেয়ারম্যান কোন পদকে আপনি বেশি গুরুত্ব দেবেন’, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো রাখঢাক না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক বলেছেন, ‘অবশ্যই যুবলীগের পদকে গুরুত্ব দেবো। যুবলীগ আমার প্রাণের সংগঠন। এই সংগঠনের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। এখন সংগঠনটি একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তা গ্রহণ করবো।’

কথা হলো তিনি কি মনে করেন যে, ক্যাসিনোকাণ্ডের প্রেক্ষিতে যুবলীগ এখন যে ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তিনি সেই সংকট থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে পারবেন? সংগঠনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন? অনেকে হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করবেন, যুবলীগের ভাবমূর্তি কবে খুব উন্নত ছিলো? যদি না থাকে তাহলে ড. মীজানের মতো একজন উচ্চশিক্ষিত লোক কি যুবলীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশের যুব সংগঠনের ইতিহাসে একটা নতুন ঘটনার জন্ম দিতে পারবেন? সম্ভবত কাজটি এতো সহজ নয়। কারণ ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠনগুলো কীভাবে চলে, তাদের মূল কাজ কী, মূল দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাদের কী কী করতে হয় এবং দলের সাইনবোর্ড ভাঙিয়ে নেতারা কী পরিমাণ লুটপাট করেন, সেটি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। এরকম একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মীজানুর রহমান যুবলীগের দায়িত্ব নিয়ে কী করবেন?

নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন যে একটা বড় সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, ছাত্ররাজনীতি এবং ক্যাম্পাসে দলীয় দাসত্ব ইস্যুতে যেসব প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তিনি বরং সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আরও বেশি কাজ করার কথা বলতে পারতেন। তিনি বলতে পারতেন, বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রাণের সংগঠন। শিক্ষার্থীরা তার সন্তানের মতো। তাদের জীবনবোধ ও নৈতিক মান উন্নত করতে তিনি সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকবেন। এ কথা জনাব মীজান বলেননি বা বলতে পারেননি। কারণ তিনি জানেন- তিনি এই কাজটি করতে পারবেন না। সে কারণে যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ তিনি সঠিক কথাটিই বলেছেন। তিনি যা বিশ্বাস করেন সেটিই বলেছেন। এখানে তিনি কোনো ভণ্ডামি করেননি। তার এই সরলতাকেই বরং আমি শ্রদ্ধা করি।

এখন কথা হচ্ছে, যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির চেয়েও যুবলীগের চেয়ারম্যানের পদকেই বড় অথবা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তাহলে আর তার শিক্ষকতা করা উচিত কী না বা শিক্ষকতা করার নৈতিক অধিকার তিনি হারিয়ে ফেলেছেন কী না? প্রশ্নটা এ কারণে যে, সংবাদটি প্রকাশিত হবার পর তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব বিতর্ক ও রসিকতা হচ্ছে, এমনকি দেশের বিশিষ্ট অনেকও মানুষও যেভাবে তার সমালোচনায় মুখর হয়েছেন, তা নিশ্চয়ই তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে না। ফলে তার উচিত ঘোষণা দিয়েই শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়া। তাছাড়া এই ঘটনার পরে ক্লাসে বসে তার লেকচার বা নীতিকথা শুনতে শিক্ষার্থীরা আর আগ্রহী হবেন কী না, তিনি টেলিভিশনের টকশোতে এসে যেভাবে সমসাময়িক নানা বিষয়ে নিজের মতামত এবং সংকট উত্তরণে পরামর্শ দেন, সেসব পরামর্শ দর্শকরা আর দেখতে চাইবেন কী না, সেটিও বোধ হয় তার ভেবে দেখা দরকার।

একজন শিক্ষক বা একজন উপাচার্য যদি তার ক্লাসরুম ও ক্যাম্পাসের চেয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয়কে বেশি প্রাধান্য দেন এবং দিন শেষে রাজনৈতিক কর্মীই হতে চান, তাহলে বরং তাকে সেটিই করতে দেওয়া উচিত। শিক্ষকতার মতো পেশায় থাকার তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। একজন সিনিয়র সাংবাদিক ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, ভিসি হিসেবে যা পাওয়ার তিনি পেয়েছেন। এখন ফুলটাইম রাজনীতিতে এসে তিনি মন্ত্রী-টন্ত্রী হতে চান। অধ্যাপক মীজানের যদি এটিই উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে বলতে হবে তিনি তার যুক্তি অনুযায়ী সঠিক পথেই আছেন।

অনেকে বলছেন, আজ উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান যুবলীগের চেয়ারম্যান হলে পদ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছেন। কাল হয়তো আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলবেন- তিনি ছাত্রলীগের দায়িত্ব নিতে চান। পরশু আরেক ভিসি অথবা প্রক্টর বলবেন- তিনি শ্রমিক লীগের সভাপতি হতে চান। তারপর হয়তো যুবলীগের নিষ্ক্রিয় চেয়ারম্যান বলবেন- তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে চান। ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি বলবেন- তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে চান। শ্রমিক বা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি বলবেন- তাকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করা হলে সেই দায়িত্ব নিতে তিনি রাজি আছেন; যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে এখানে ভিসি পদটি শূন্য। কথাগুলো হাস্যকর শোনাচ্ছে বটে। কিন্তু আজ আমাদের ভিসিগণ এই পদকে যেভাবে কলঙ্কিত এবং বিতর্কিত করেছেন, তাতে ভবিষ্যতে কোনো আদর্শবান শিক্ষক আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে চাইবেন কী না, তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কারা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন, সেটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তের তালিকায় চোখ রাখলেই পরিষ্কার হবে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ১৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের লিখিত অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য, অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি-পদায়ন, অর্থ আত্মসাৎ, উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার ইত্যাদি। সম্প্রতি গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নাসিরউদ্দিনকে নিয়ে যা হলো, আন্দোলনের মুখে তিনি যেভাবে ক্যাম্পাস ছেড়ে ‘পালিয়ে গেলেন’, তাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ভাবমূর্তি বলে কিছু আর অবশিষ্ট আছে কী না সন্দেহ। যদি না থাকে তাহলে তাদের শিক্ষকতা ছেড়ে ফুলটাইম রাজনীতি করাই ভালো। বরং তাতে ভবিষ্যতে এমপি-মন্ত্রী হওয়ার চান্স থাকবে।

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দুর্নীতি করবেন এবং মঞ্জুরি কমিশনকে সেটি যদি তদন্ত করতে হবে, তার চেয়ে লজ্জার কিছু হতে পারে না। যদি কোনো ভিসির ব্যাপারে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং তিনি যদি দুর্নীতি নাও করে থাকেন, তারপরও তো তারা নৈতিক কারণে পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত। এটুকু মোরালিটি বা এটুকু নৈতিক সাহস এবং মেরুদণ্ডের জোর তো আমরা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছ থেকে আশা করতে পারি।

অনেকে হয়তো বলবেন, যেখানে রাষ্ট্রের সব পেশায় ও সব প্রতিষ্ঠানে পচন ধরেছে, সেখানে আলাদা করে শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা কেনো নীতি নৈতিকতা বা মেরুদণ্ডের জোর প্রত্যাশা করি? করি এ কারণে যে, শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তাহলে সেই মেরুদণ্ডের কারিগর শিক্ষকরা। তাদের নিজেদের মেরুদণ্ড না থাকলে জাতির মেরুদণ্ড তারা কীভাবে সোজা করবেন? বরং শিক্ষকও যদি মেরুদণ্ডহীন প্রাণিতে পরিণত হন, তাহলে সেই জাতির কোমর সোজা করে দাঁড়ানো কঠিন। এ কারণে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে যায়, যখন প্রশাসনে দলীয়করণ আর দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যায়, যখন মানুষকে ঠকানোই ব্যবসায়ীদের মূল কাজে পরিণত হয়, যখন সকল পেশাজীবীর লোক অন্যকে ঠকানোর ধান্দায় ব্যস্ত থাকে, তখনও শিক্ষকের কাছ থেকে মানুষ সততা ও নীতি-নৈতিকতা প্রত্যাশা করে। কিন্তু সেই শিক্ষকের কাছে, সেই উপাচার্যের কাছে যদি শিক্ষকতার চেয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান হওয়াটাই লোভনীয় এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে জাতির মেরুদণ্ড বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

আমীন আল রশীদ, বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

aminalrasheed@gmail.com