আবু বকর থেকে আবরার: বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে!
শহীদ আবু বকর সিদ্দিকের কথা মনে আছে? মনে থাকবে কীভাবে! অগণিত ঘটনা, খুন আর নতুন ইস্যুর বিনিময়ে হারিয়ে যায় মানসপটে ক্ষত তৈরি করা ঘটনাগুলোও। আমি ২০১০ সালে ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের দু'গ্রুপের সংঘর্ষে খুন হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকরের কথা বলছি।
আবু বকর খুন হওয়ার পর সেদিনও ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মিছিল হয়েছিল, প্রতিবাদ হয়েছিল। সেই প্রতিবাদে শামিল হতে গিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে ঢোকাও নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবু বকরও মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ফলাফলে প্রথম স্থান অর্জন করে জানিয়ে দিয়েছিল, তাঁকে ধারণ করার ক্ষমতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেই।
আবু বকরের মায়ের কান্নার দাগ এখনো শুকায়নি। কিন্তু এরইমধ্যে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, আবু বকর হত্যায় জড়িত ছাত্রলীগের অভিযুক্ত ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অর্থ্যাৎ আবু বকরকে কেউ খুন করেনি!
ময়না তদন্তের রিপোর্টে যে বলা হয়েছিল, শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকরের মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছিল- তা সবই ভূল! শুধু আবু বকর নেই এটাই সত্যি! আবু বকরদের কাতারে নতুন করে যুক্ত হলো শহীদ আবরার ফাহাদ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস বিভাগের এক দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থী। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেশ সেরা বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয়ে অনেক স্বপ্ন বুননও শুরু করেছিল। কিন্তু সেই মুহুর্তে বেকসুর খালাস পাওয়া হায়েনারা ভিন্ন চেহারায় স্যার এ. এফ. রহমানে হলের পরিবর্তে এবার হাজির হলো শেরে বাংলা হলের ২০১১ নং কক্ষে। নৃশংস-বর্বরতম উপায়ে মেতে উঠল- এক দেশপ্রেমিক তরুণ হত্যায়। ফের জানিয়ে দিলো- এই বাংলাদেশ, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এই বুয়েট, এই শিক্ষাঙ্গনে হায়েনারা স্থায়ী নিবাস গেড়েছে অনেককাল আগে থেকেই।
আবু বকর, আবরারদের মতো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ৪৫ বছরে হারিয়েছি অন্তত ১৫১ জনকে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত শিক্ষার্থী খুনের মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার আঙ্গিনাগুলোতে যেভাবে হায়েনারা বসতি শুরু করেছিল। তা দিন যত গেছে ততো ভয়ংকর হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।
জানা গেছে, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ আঙ্গিনা হায়নাদের আঘাতে রক্তে রক্তিম হয়েছে অন্তত ৭৪ বার! পড়তে এসে, পড়া শেষ হওয়ার আগেই লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে তাদের। তাঁদেরকে নিয়ে যে বাবা-মা একদিনে স্বপ্ন দেখেছিল প্রিয় সন্তানটি উচ্চশিক্ষা অর্জন করে পাশে এসে দাঁড়াবে; সেই বাবা-মা সবচেয়ে আদরের সন্তানটিকে দাফন করছে চোখের পানিতে।
শিক্ষাঙ্গনে পড়তে এসে মৃত্যুর এই মিছিলে, শত-শত মায়ের বোবার কান্নার নোনাধারায় আর কত আবু বকর, আবরারকে শরিক হতে হবে তা আমরা জানি না। আমরা এটাও জানি না, এই মৃত্যুর মিছিলে আদৌ স্থায়ী বিরতি আসবে কিনা। এসব না জানার মধ্যে একদিন আমরা হয়তো জানবো, শহীদ আবরারের খুনীরাও বেকসুর খালাস! করুণ বাস্তবতায় শহীদ আবরারকেও আমরা ভুলে যাব।
রাষ্ট্রযন্ত্র, দলীয় প্রশাসন ও বিদ্যমান বিচারব্যবস্থাও আবরারদের ভুলে যাওয়ার সব আয়োজন প্রস্তুত করে রাখবে। এভাবেই আবু বকর, আবরার হত্যার বিচার নীরবে নিভৃতে চলে যাবে। শুধু বহমান থাকবে সন্তানহারা মায়ের বোবা কান্না।
লেখক: ৩৫তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত
এবং লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউিনভার্সিটি