ন্যাচারাল জাস্টিস ও একটি সত্য ঘটনা
প্রকৃতির সবচেয়ে সুবিধাভোগী মানুষ হলেও এর জন্য সবকিছু শর্তহীন ও উন্মুক্ত নয়, বরং তা মানুষকে বিধি নিষেধের আওতাধীন করে দেওয়া হয়েছে। মানুষের পক্ষে কোনোভাবেই স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষ যখন সৃষ্টির বিধিবদ্ধ নিয়মে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তখন এই বিশ্বচরাচর গতিশীল, শান্তিময়, সুশৃঙ্খল ও আনন্দঘন হয়ে উঠে। কিন্তু যখন এর ব্যত্যয় ঘটে তখনই তা ছন্দ হারিয়ে ফেলে ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে এই সৃষ্টি জগতের। আর এই নিয়মভঙ্গকে অবশ্যই অপরাধ বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। প্রকৃতি বলতে গোটা সৃষ্টিজগতকে নির্দেশ করে। এই বিশ্বজগত মানবসৃষ্ট নয়। এমন দৃশ্য-অদৃশ্য বিষয় এবং জীবন ও প্রাণ নিয়েই প্রকৃতি। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, " প্রকৃতি মাঝে মাঝে মানুষকে এমন বিপদে ফেলে। চোখে পানি আসার সিস্টেম না থাকলে জীবন যাপন হয়তো সহজ হতো। ”
আমরা কেউ প্রকৃতির প্রতিশোধের ঊর্ধ্বে নই। যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী নয় তারা পৃথিবীর সব কিছু প্রকৃতির লীলাখেলা বলে চালিয়ে দেয়। ভালো মন্দ যাই ঘটুক না তা প্রকৃতির ইশারায় সম্পাদিত হচ্ছে বলে তারা বিশ্বাসী। তবে আল্লাহ, ভগবান ও গডে বিশ্বাসীরা সরাসরি প্রকৃতি না বলে আল্লাহ, গড ,ভগবান বা ঈশ্বরের ইচ্ছায় সবকিছু সংঘটিত হয়ে থাকে বলে বিশ্বাস করেন। তারা এসবের মূলে স্রষ্টার ইঙ্গিত তালাশ করেন। তবে প্রকৃতি স্রষ্টা যাই বলি না কেন মানুষ অপরাধ করলে তার শাস্তি দুনিয়াতে তো পাবেই।আর পরজীবনের শাস্তি তো রয়েছেই।পার্থিব জগতে কোন পাপের কী শাস্তি হয়, এ প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠতম তাফসিরবিদ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘কোনো জাতির মধ্যে আত্মসাৎ করা বৃদ্ধি পেলে সে জাতির লোকদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করা হয়। কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে সেখানে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা পরিমাপ ও ওজনে কম দিলে তাদের রিজিক সংকুচিত করা হয়। কোনো জাতির লোকেরা অন্যায়ভাবে বিচার-ফয়সালা করলে তাদের মধ্যে রক্তপাত বিস্তৃতি লাভ করে। কোনো জাতি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আল্লাহ শত্রুদের তাদের ওপর চাপিয়ে দেন। (মুয়াত্তা মালেক )। কেউ অপরাধ করলে প্রকৃতির রূঢ়তা ও নির্মম প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারে না। কোনো-না-কোনোভাবে প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়।পারিবারিক ও সামাজিক ঝগড়া বিবাদ, গণমানুষের রুদ্ররোষ, রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, অপঘাত-অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগভোগ, দুর্ঘটনা, নানাবিধ প্রতিকূলতায় শাস্তি পায়। আর এই প্রাপ্য শাস্তি হয় মানুষের কল্পনারও অতীত। এ বিষয়ে অসংখ্য উদাহরণ ও যোগ্য নজির আছে।আমাদের চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, যারাই মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যের হক নষ্ট করেছে, কষ্ট দিয়েছে, জুলুম করেছে প্রকৃতির নির্মমতা তারা কখনোই উপেক্ষা করতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় দেখেছি গেস্টরুম ও হলে বিভিন্ন ভাবে যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার নির্যাতন করেছে, হলে থাকা অবস্থায় এসব অনাচারের প্রতিদান তথা প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ তাদের কপালে জুটেছে। ফলে অনেক উৎপীড়ক ছাত্রজীবন শেষ করতে পারেনি।তাদের অনেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়েছে। আবার অনেককে হল থেকে লাঞ্ছিত ও উত্তম মধ্যম দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে।সেই সময় যারা মানসিক ও শারীরিকভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছিল তারা এখন বাংলাদেশের অনেক ভালো জায়গায় পোস্ট পজিশন হোল্ড করছে। ক্যাম্পাসে একটি কথা প্রচলিত আছে যারা অন্যায় ভাবে কাউকে একটা থাপ্পড় দেবে তাকেও ঠিক একই পরিমাণ ও ওজনের থাপ্পড় হজম করতে হবে। হোক না সেটা দুদিন আগে বা পরে।চোখের সামনেই দেখেছি যারা খুব বেশি ফাঁপরবাজি করতো, সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন করতো তাদের দুঃসময় আসতে অপেক্ষা করতে হয়নি। অনেককে খালি হাতে সনদ ছাড়া ভার্সিটি ছাড়তে হয়েছে। এখন সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা বুয়েটের আবরার হত্যাকান্ড। বুয়েটে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে এবার একটি ন্যাচারাল জাস্টিসের ঘটনা বলি।
বুয়েটের সাবেক এক শিক্ষার্থী এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।যা ন্যাচারাল জাস্টিসের মধ্যে পড়ে। বর্ণনাটি ছিল এমন। ২০১৫ সালের বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শুভ্র জ্যোতি টিকাদারের নির্যাতনের কথা। এই শুভ্র জ্যোতি টিকাদার বুয়েটের এক ছাত্র ও কোরআনের হাফেজকে বেধড়ক মারপিট করে। এই শুভ্র জ্যোতি টিকাদার সেই কোরআনের হাফেজের মুখে লাথি মারে। আরেকজন ছাত্রলীগ নেতা নির্যাতিত ছাত্রের ক্ষত মুখে লবণ ছিটিয়ে দেয়।নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনাকারী বুয়েটের সাবেক সেই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার নিজ চোখে দেখা সেই অমানবিক দৃশ্য। টিউশন শেষ করে নজরুল হলে প্রবেশের আগেই আউলার গেট থেকেই শুনতে পেলাম গগণবিদারী আর্তনাদ। ঢুকতেই দেখি ইউকসুর সামনে কেউ পড়ে আছে। তাকিয়ে দেখলাম মাটিতে ফেলে একজনকে পেটানো হচ্ছে ।যে মার খাচ্ছে সে পরিচিত এক ভাই, উনি কোরআনের হাফেজ ।প্রত্যক্ষদর্শী এই সাবেক বুয়েটিয়ান বলেন, ‘শুভ্র জ্যোতি তাকে মাটিতে ফেলে তার মুখমন্ডলে অনবরত লাথি দিচ্ছে। একজন হাফেজের মুখে! তারপর কোত্থেকে একটা মোটা বাটাম নিয়ে এসে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে পিটাতে লাগল শুভ্র। কে যেন ক্যান্টিন থেকে লবণ নিয়ে এসে দিল ০৭তম ব্যাচের তন্ময়কে। সে ভাইকে তুলে তার রক্তাক্ত মুখে লবণ লাগিয়ে দিল। এরপরে আর সহ্য করতে পারিনি বলে হলে চলে আসি।
সাবেক বুয়েটের এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘যে কয়দিন ক্যাম্পাসে ছিলাম, শুভ্র জ্যোতির দিকে তাকালেই তার সেই নৃশংস চেহারার কথা মনে পড়ত।। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সেই দাপুটে প্রতাপশালী সভাপতি শুভ্র জ্যোতি টিকাদার চলতি বছরের ৪ জুনে আত্মহত্যা করে। এইদিন রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাসা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আগের দিন রাতে কোনো এক বিষয়ে তার স্ত্রীর নাদিয়া বিনতে রউফের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। ১২টার পর শুভ্র তার রুমের দরজা বন্ধ করে দেন। স্ত্রী নাদিয়া রাতে ছিল পাশের রুমে। রাতে আর কেউ কারো খোঁজ নেয়নি।পরে বিকেলে শুভ্র জ্যোতির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।
শুভ্রর স্ত্রীর বরাত দিয়ে নিউ মার্কেট থানার এসআই আলমগীর বলেন, ‘দুপুরেও উঠছে না দেখে শুভ্রর রুমের বাইরে ফ্রিজের ওপর যে চাবি ছিল, সেই চাবি দিয়ে তার স্ত্রী নাদিয়া দরজা খুলে দেখেন শুভ্র ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ঝুলিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্রর বাবাকে ফোনে ঘটনাটি জানায়। শুভ্রর বাবা পাশের ভবনেই থাকতো। তিনি এসে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে বঁটি দিয়ে ওড়না কেঁটে ছেলেকে নিচে নামান।’
শুভ্র জ্যোতির মরদেহের বর্ণনায় এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘তার জিহ্বা বের করা অবস্থায় দাঁত দিয়ে চেপে ছিল। গলার সামনের অংশে কালো দাগ ছিল, চেহারা কিছুটা কালো হয়ে যায়। পায়ের নিচেও কালো হয়ে যায়।এই নরাধম পাষণ্ডের আত্মহত্যার খবর শুনে এক তাচ্ছিল্যের হাসি সেদিন হেসেছিলাম বললেন বুয়েটের সেই সাবেক শিক্ষার্থী।
এই দুনিয়ায় যারাই দম্ভ দেখিয়েছে , ক্ষমতার দম্ভে সবকিছু তুচ্ছ ভেবে অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে, সমাজে খুনখারাবি, মানুষের অধিকারহরণ, বিশ্বাসভঙ্গ, নিপীড়নসহ লাগামহীন অপরাধ করেছে এবং মানুষের জানমাল, নানাভাবে সম্ভ্রম নিয়ে আনন্দে লিপ্ত হয়েছে, মনে কষ্ট দিয়েছে তাদের পরিণতি মোটেই সুখপ্রদ হয়নি। প্রকৃতি তাদেরকে কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক