তিল তিল করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে
তিল তিল করে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে, যেখানে যার দায়িত্ব ছিলো তিনিই এই ধ্বংসলীলায় অংশ নিয়েছেন। দলের স্বার্থে, ব্যক্তিগত স্বার্থে, ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য লাভের আকাঙ্ক্ষায়, লোভের তাড়নায় তাঁরা জেনে শুনেই এগুলো করেছেন। এই ধ্বংস সাধনই আদর্শ। তা অর্জনই সাফল্য বলে বিবেচিত হয়েছে, সেই জন্যে পুরস্কৃত হয়েছেন।
অন্যরা সেই পথে যাবার জন্যে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে এই নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। তাঁদের বিবেকের কাছে আবেদন করা হয়েছে, মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে শিক্ষকতার মর্মবাণী কী। কিন্ত কা কস্য পরিবেদনা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা, তাঁদের সিপাই-বরকন্দাজ নিয়ে জমিদারের মত করে চালিয়েছেন/চালান সবকিছু।
তাঁদেরকে রক্ষা করার কাজ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র কর্মীদের হাতে ন্যস্ত নাকি সরকারী দলের কর্মীদের রক্ষার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষদের হাতে সেটাই বোঝা যায়নি। আজ থেকে ৪ বছর আগে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে লিখেছিলাম, ‘দলীয় আনুগত্যের কারণে শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রকর্মীদের সম্পর্ক শিক্ষক-ছাত্রের চেয়ে একই দলের সহযোদ্ধার মতো। তদুপরি ক্ষমতাসীনদের কাছে ছাত্রনেতারা যত সহজে পৌঁছাতে পারেন, একই দলের অনুগত শিক্ষকেরাও প্রায়ই সেই সুযোগ পান না। ফলে ছাত্রনেতারা হয়ে ওঠেন তাঁদের যোগাযোগের বাহন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ ব্যবহারও নতুন ঘটনা নয়। দলীয় বিবেচনায় প্রশাসনিক পদে নিযুক্তির কারণে নিয়োগকৃতদের রক্ষা করার অলিখিত দায়িত্ব বর্তায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা ও কর্মীদের ওপরে’ (আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি, প্রথম আলো, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫)।
তখন মনে হয়েছিলো ক্ষমতাসীনদের ছাত্রকর্মীরা এই সব দলীয় অনুগত প্রশাসনকে রক্ষা করে। তারপরে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাজনীতিতে ভিন্নমতের যতটুকু জায়গা ছিলো সেটা অবসিত হয়েছে, বল প্রয়োগ করে শাসন জোরদার হয়েছে, নির্বাচন নামে নৈশকালীন নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে, রাজনীতিরই অবসান হয়েছ।
আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-প্রশাসকদের কাজ হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের রক্ষা করা। অন্যথায় বুয়েটের ছাত্রাবাসে ‘টর্চার সেলের’ খবর উপাচার্য, প্রাধ্যক্ষ জানতেন না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে এই ধরণের রুমগুলোর কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানেন না? গণরুমের উপস্থিতির কথা, সেখানে কী হয় তার কিছুই জানেন না?
ছাত্রলীগের নেতাদের ‘প্রটোকল’ দেয়ার ব্যবস্থা আছে, তার অন্যথা হলে কী শাস্তি হয় তার খবর তো নিশ্চয় দেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে কোয়ার্টার তৈরি হয়, কর্মচারীদের জন্য আবাসস্থল নির্মান হয়। কিন্ত গণরুমের ছাত্রদের জন্যে ছাত্রাবাস তৈরি হয়না। ভিন্নমতের কোনও জায়গা নেই, নতুন চিন্তার কোনও পথ নেই। এর মধ্যেই বেঁচে থাকে শিক্ষার্থীরা। আর আছে ‘শিক্ষকদের রাজনীতি’।
মানে-গুণে তা ছাত্র রাজনীতির নামে ক্ষমতাসীন দলের যে আচরণ তা থেকে খুব ভিন্ন তা দাবি করা যাবে না। এই সব সমস্যার সমাধান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে খুঁজে লাভ নেই– সেই সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এর সমাধান রাজনীতিতে। ফলে যে আলোচনা রাজনীতির বিষয়কে বিবেচনায় নিচ্ছে না, তাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে সমাধান খুঁজছে তার উদ্দেশ্য এই দুর্দশার সমাধান নয় – যা আছে তাকেই বহাল রাখা। সেই আলোচনায় অংশগ্রহণ সময়ের অপচয় মাত্র।
লেখক: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্রে