বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের আদ্যপান্ত, ফৌজদারি মামলা নয় কেন?
এক.
গত ১১ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কর্মরত সাংবাদিক ফাতেমা তুজ জিনিয়াকে একাডেমিক বহিষ্কারের পর আবার আলোচনায় আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনের ফেসবুক আইডি হ্যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা বানচালের হুমকিসহ একাধিক অভিযোগে ওই ছাত্রীকে বহিষ্কার করা হয়।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি অভিযোগও প্রমাণ করতে পারেনি। সারাদেশের ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের চাপ ও আন্দোলনের আল্টিমেটামের মুখে ১৮ সেপ্টেম্বর বহিষ্কারাদেশটি প্রত্যাহার করা হয়। এর আগেও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯ শিক্ষার্থী বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৮ সেপ্টেম্বর জিনিয়ার বহিষ্কারাদেশ ইস্যু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পিছু হটলে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। কারণ শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন, অন্যায় ও অপশাসনের ‘গলা চেপে ধরার’ যথোপযুক্ত সময় এটি।
জিনিয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ১৬ সেপ্টেম্বর আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও কর্মরত সাংবাদিক শামস জাবিনকে পরীক্ষার হল থেকে তুলে নিয়ে উপাচার্যপন্থী একদল ছাত্র নির্যাতন করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কথায় কথায় শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করলেও এ ঘটনায় দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
তবে হামলার অভিযোগের তীর স্বয়ং উপাচার্য নাসির উদ্দিনের দিকেই। আর হামলাকারীরা উপাচার্যের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে আসছিলো দীর্ঘদিন। এ ঘটনার দায় উপাচার্য এড়াতে পারেন না। উপাচার্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইনানুসারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
দুই.
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কত ধরণের অনিয়ম হতে পারে? এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ গোপালগঞ্জের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর শিক্ষকদের একটি পক্ষও ১৬টি দাবি সম্বলিত একটি চিঠি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দিয়েছে। চিঠিতে উল্লেখিত দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে অনিয়মের বিষয়টি আরো পরিস্কার হবে।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষার্থীদের ওপরই বিভিন্ন সময় অন্যায় আদেশ এসেছে- এমন নয়৷ শিক্ষকরাও অবিচারের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সভাপতি/চেয়ারম্যান/পরিচালক/প্রধান নির্ধারিত হয় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান নির্ধারিত হয় উপাচার্য নাসির উদ্দিনের পছন্দের ভিত্তিতে।
এই কারণে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা চরম অপমানের শিকার হয়েছেন বার বার। এর ফলাফল, তুলনামূলক তরুণ শিক্ষকরা ‘প্রভাবশালী’ পদে বসে উপাচার্যের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। উপাচার্যের বিরোধীতা করার কেউ থাকে না। উপাচার্য তার নিজস্ব একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি করে, পেশিশক্তি প্রয়োগ করেন। তাই এতো অন্যায়-অনিয়মেও কেউ মুখ খুলেন না।
উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১০৭ শিক্ষক উপাচার্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। সবাই প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক। তারাই উপাচার্য প্রদত্ত ‘সুবিধাভোগী শ্রেণি’। এছাড়া প্রশাসনিক দায়িত্ব, আবাসিক সুবিধাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায়ও জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে।
শুধু চেয়ারম্যানশীপেই নয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোন স্বকীয়তা নেই। কারণ বিভাগগুলোতে কোন প্ল্যানিং কমিটি নেই। এর ফলে ‘উপাচার্য নিয়ন্ত্রিত’ রিজেন্ট বোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ-পদোন্নতিতে উপাচার্যের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটে। উপাচার্যপন্থীরা এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার ও সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
বাংলাদেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনিয়ম আছে কিনা- আমার জানা নেই! এই ঘটনা সকল অনিয়মকে ছাড়িয়ে নজির হওয়ার দাবি রাখে। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক সভা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ ‘ওপেন প্রোগ্রামে’ উপাচার্য নাসির উদ্দিন শিক্ষকদের নিয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য করে থাকেন। এর কোন প্রতিকার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের মত ভর্তির ক্ষেত্রেও অঘোষিত ‘উপাচার্য কোটা’ রয়েছে। এমনকি ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল সংশ্লিষ্ট ডিন অফিস অথবা বিভাগগুলোর কাছে দেয়া হয় না। অর্থাৎ ‘একটি চক্র’ উপাচার্যের সহযোগী হিসেবে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে জিম্মি করে রেখেছে। তারাই সবকিছু পরিচালনা করেন, সুবিধা ভোগ করেন।
তিন.
উপাচার্যের প্রশাসনিক অনিয়মের পাশাপাশি আর্থিক দুর্নীতির পাহাড়ের খবরগুলো গত কয়েকদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। অথচ প্রকল্পের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা ছাড় হয়েছে, যা বাজেটে ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু যে স্থানটি ম্যুরালটি স্থাপিত হওয়ার কথা, ওই স্থানে এখনো সবুজ ঘাস। একটি ইটও বসানো হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃক্ষরোপণের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকার ‘গোবর ক্রয়’ করা হয়েছে বলেও ব্যয় দেখানো হয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ধরনের দুর্নীতির রেকর্ড থাকলেও ‘গোবর বাণিজ্যের দুর্নীতি’ একটি বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ তহবিলের টাকা উপাচার্যের ‘ইচ্ছে মত’ ব্যয়ের অভিযোগ আছে। বিডি নিউজ টুয়েন্টফোরের খবর জানিয়েছে, এই তহবিলের জন্য প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। গত বছরের ১২ মার্চ থেকে চলতি বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিল থেকে ৩৬৫ জনকে নামে-বেনামে ৭১ লাখ ৯০ হাজার ২৭৮ টাকা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এর মধ্যে ২০১৮ সালের ৯ অগাস্ট ‘গ্রামবাসীদের সাথে মারামারির সময় ছাত্রদের আপ্যায়ন বাবদ’ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এ বছরের ২৮ মে ‘গ্রামবাসীদের সঙ্গে মারামারির কারণে মোটরসাইকেলে ক্ষতির জন্য আর্থিক সাহায্য’ নামে দেওয়া হয়েছে ১৮ হাজার ৩৬৫ টাকা। গ্রামবাসীদের সঙ্গে যে মারামারি হয়েছে, তার মামলা পরিচালনার জন্য কাজী মেজবা উদ্দীন নামের একজনকে দুই দফায় ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিলের বড় অর্থ খরচ হয়েছে চিকিৎসা ও লাইব্রেরি ডিউটি খাতে। তবে কয়েকজনের চিকিৎসা খরচ ও চিকিৎসা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। জাহাঙ্গীর আলম নামে একজন শিক্ষার্থী গত বছরের ১৭ জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত সাত দফায় একই চিকিৎসার জন্য এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছেন। ফেস্টুলা চিকিৎসায় ভারতে যাওয়ার জন্য গত ১৪ মার্চ এক লাখ ৯০ হাজার টাকা নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম সাকিব, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় এই দুজনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় ছাত্র সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুজ্জামান সোহাগের নামে গত ২১ মে ২৫ হাজার এবং ২৭ মে আরিফুল ইসলামকে আরও ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে খাতের জায়গায় লেখা হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিজস্ব ‘পেটোয়া বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে সংগঠনটির সদস্যদের। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকের ওপর হামলা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে সংগঠনটির সদস্যদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ‘বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের অ্যাপায়ন’ বাবদ দুই লাখ টাকা ছাত্র-কল্যাণ তহবিল থেকে ইমরুল বিশ্বাস নামে একজনকে দেওয়া হয়। এত টাকা ব্যয় দেখানো হলেও ঈদে বিশেষ কোন আয়োজন ছিল না বলেও জানিয়েছেন বিদেশী শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ডিউটির নামে ৫৫ জন শিক্ষার্থীকে মাসে তিন হাজার টাকা করে দেয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ তহবিলের এ বিশাল অংশ যাদের দেয়া হয়েছে, তারাই উপাচার্যের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত। উপাচার্য নাসির উদ্দিন টাকা দিয়ে ক্যাম্পাসে একটি ‘বিশাল সিন্ডিকেট’ হাতে রেখেছেন- এই প্রমাণই পাওয়া যাচ্ছে উল্লেখিত হিসেব থেকে। জনগণের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় দুর্নীতির পর শুধু উপাচার্যের অপসারণ নয়, তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত ও মামলার দাবি রাখে।
চার.
জিনিয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর শামস জাবিনকে পরীক্ষার হল থেকে তুলে নিয়ে মারধর করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, উপাচার্যের নির্দেশে ‘পেটোয়া বাহিনী’ এই সাংবাদিকের ওপর হামলা চালিয়েছিল। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন পদক্ষেপই নেয়নি। এর দ্বারা প্রমাণ হয়- শিক্ষার্থীদের দমন করতে উপাচার্য যে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পিছপা হননি।
গত ২১ সেপ্টেম্বর আন্দোলনে যোগ দিতে আসা শিক্ষার্থীদের ওপরও হামালা চালানো হয়। এসময় শিক্ষার্থীরা জীবন বাঁচাতে বিলে নেমে পড়েন। এই হামলার ঘটনার তীরও উপাচার্য নাসির উদ্দিনের দিকে। উপাচার্য যদিও হামলায় সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করছেন।
কিন্তু বোববার সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ও ডয়েচেভেলের বাংলা ভার্সনের খবরে জানানো হয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তেই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হামলার প্রতিবাদে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. হুমায়ুন কবির।
আন্তজার্তিক গণমাধ্যম দুটিকে এই শিক্ষকের বলেছেন, ‘শনিবার সকাল ৯টায় ভিসি শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করেন । সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ও হল বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেন। হলের বিদ্যুৎ, পানিসহ সব সুবিধা বন্ধের কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের যেকোনো মূল্যে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দিতে হবে। হল খালি করতে হবে। প্রয়োজনে ওদের বহিরাগতদের দিয়ে মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে। তিনি সিদ্ধান্ত দেন পাশের সোনাপুর গ্রাম থেকে বহিরাগত এনে ছাত্রদের পিটিয়ে প্রবেশ থামানো হবে। আর ভিতরে যারা আছে তাদের বহিরাগত দিয়ে হামলা করে বের করে দেয়া হবে।’
‘বহিরাগতরা ধারালো দেশীয় অস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পথে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে পাশের ঝিলে ফেলে দেয়া হয়। মিটিং-এর সিদ্ধান্তের সময় আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি। কিন্তু হামলার পর বিবেকের তাড়নায় আমি পদত্যাগ করি।’
একজন উপাচার্য বহিরাগতদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করেছেন আন্দোলন দমাতে। শিক্ষক হুমায়ুন কবিরের ভাষ্য অনুযায়ী, উপাচার্য খোন্দকার নাসির হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। এরপরও তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে থাকার কোন যোগ্যতাই রাখেন না। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে তাকে শুধু উপাচার্য পদ থেকে অব্যহতিই নয়, শিক্ষকতার চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা উচিত।
আর এ ঘটনায় নির্দেশ দাতা হিসেবে বাংলাদশের আইনে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হওয়া উচিত। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। না হয়, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।
পাঁচ.
উপাচার্য খোন্দকার নাসিরের মুখের ভাষা নিয়ে আপত্তি উঠেছে দেশব্যাপী। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের যখন তখন ডেকে নাজেহাল করেন। বাবা-মা নিয়েও অসম্মানজনক মন্তব্য করেন নিয়মিত। ফাঁস হওয়া অডিওতে উপাচার্য দাবি করেছেন- তিনি বিশ্ববিদ্যালয় না খুললে শিক্ষার্থীরা পড়তে পারতেন না। আরেকটি অডিওতে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের ‘জানোয়ার’ বলে সম্বোধন করেছেন।
তিনি বলেছেন, সরকার তাকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাষ্ট্রদূত, এমপি অথবা মন্ত্রী বানাবেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর একটি অনুষ্ঠানে তিনি স্বীকার করেছেন, ‘জেনেটিক্যালি আমার আচরণ এমন। আমি ভুলও স্বীকার করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী মত প্রকাশ করতে পারেন না। তাদের হয়রানি করা হয়। শিক্ষকদেরও হেনেস্তা করা হয়। এছাড়া ওই উপাচার্যের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, নিজ বাসভবনে বিউটি পার্লার খুলে বসার অভিযোগও রয়েছে। এমন অযোগ্য একজনকে একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে রাখা হবে, ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়।
ছয়.
১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী জিনিয়ার বহিস্কারাদেশ তুলে নেওয়ার মাধ্যমে প্রমাণ করে, ওই শিক্ষার্থী নিরপরাধ ছিলেন। তাই এই শিক্ষার্থীকে হেনস্তার দায়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আন্দোলন শুরুর পর ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের ১৪টি দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আন্দোলনের শুরুতে উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া অন্য কোন দাবি জানাননি।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওই বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করলে এতদিনের অন্যায়ের বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে- ছয় মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে; উন্নয়ন ফির নামে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হবে না; শিক্ষার্থীদের বাক স্বাধীনতা প্রদান করা হবে; অভিভাবকদের ডেকে অপমানিত করা হবে না; ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জেরে শিক্ষার্থীদের বহিস্কার করা হবে না; বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ও পরিবহন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হবে না। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতদিন এসব অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলো বলে স্বীকার করে নিয়েছে।
প্রশ্ন হলো- এসব অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির শাস্তি হবে না? শুধু উপাচার্য পদ থেকে অপসারণ যথোপযুক্ত শাস্তি বা সমাধান নয়। অপসারণের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, তবে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ও প্রশাসনের এসব অন্যায়ের বিচার না হলে বিচারহীনতা সংস্কৃতিতে নতুন নজির যুক্ত হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (চবিসাস)
mujobaer.cu@gmail.com