আত্মত্যাগে চিরভাস্বর ঈদুল আজহা
আজকের দিন শেষ। রাত পোহালেই মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎস ঈদুল আজহা। যদিও আজ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরবদেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে। আগামীকাল বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে ঈদ উদযাপিত হবে। ঈদ মানে খুশি ও আনন্দ হলেও ঈদুল আজহায় রয়েছে ত্যাগের মধ্যে মহিমায় আনন্দের নজির। যা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য ও অনুসরণীয়।১০ জিলহজ্জ্ব ঈদুল আজহার নামাজের পর জিলহজ্জ্ব মাসের ১০, ১১, ১২ তারিখ পর্যন্ত পশু কুরবানী করে মুসলমানরা ঈদুল আজহা উদযাপন করে থাকি।
আমরা যারা কুরবানী করি আমাদের কুরবানী পশুর রক্ত মাংস চামড়া, হাড় কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। আল্লাহ শুধু আমাদের নিয়ত, তাকওয়া আত্মত্যাগ দেখেন। এই আত্মত্যাগ যেন হয় শুধু আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সব কিছু সমগ্র জগতের মালিক আল্লাহর তায়ালার জন্য। (সূরা আন-আম আয়াত-১৬২ )।কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘােষণা দেন যে, আমাদের কাছে নিজের জান মাল অপেক্ষা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনেক বেশি কাম্য । কুরবানির পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে এর রক্ত প্রবাহিত করে আল্লাহর কাছে শপথ করে বলে হে আল্লাহ তোমার রাজি খুশির জন্য যে ভাবে পশুর রক্ত প্রবাহিত করছি প্রয়োজনে তোমার জন্য আমাদের শরীরের রক্ত প্রবাহিত করতেও কখনো দ্বিধাবোধ করবো না। উইকিপিডিয়ার মতে,
কুরবানী শব্দটি হিব্রু কোরবান আর সিরীয় ভাষার কুরবানা শব্দদুটির সংগে সম্পর্কিত যার আরবী অর্থ "কারো নিকটবর্তী হওয়া।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, কুরবানীর সামর্থ থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করেনা সে যেন আমাদের ঈদের ময়দানে না আসে '।কুরবানি প্রদানের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি উত্তম ইবাদত এবং ওয়াজিব। হাদিস শরিফে রাসুল (স.) বলেন, কুরবানির দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কাজ আল্লাহর নিকট আর কিছু নেই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন কুরবানির পশুর শিং ক্ষুর ও লোমসমূহ নিয়ে হাজির হবে। কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানির ধারা নিজেদেরকে পবিত্র কর (তিরমিজি)।কাজী নজরুল ইসলাম শহীদী ঈদ কবিতায় বলেন–
‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে
মুসলিম নহে ভ- সে
ইসলাম বলে বাঁচ সবাই
দাও কোরবানী জান ও মাল
বেহেশত তোমার কর হালাল
স্বার্থপরের বেহেশত নাই।’
আজ অনেকে আমরা লোকচক্ষুর ভয়ে সামাজিকতা রক্ষায় কুরবানি করে থাকি। লোকে কি বলবে? আবার তরুতাজা মোটা গরু বাজার থেকে আনি গলায় মালা দিয়ে। নিজের কয়েক লাখ টাকার কুরবানীর পশু প্রদর্শন করে আমরা বাহবা মারহাবা পেতে চাই। যা কুরবানীর উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। নেক নিয়ত ও ভবিষ্যতে ইসলাম ও ন্যায়ের পক্ষে নিজের জীবন উৎসর্গ করার শিক্ষাই আমরা কুরবানি থেকে পাই। কুরবানী পশু হলো প্রতীকী কুরবানি কিন্তু নিজের জীবন রক্ত মহান আল্লাহ পাকের জন্য কুরবান করাই হলো আসল কুরবানি। যখন এ কুরবানির সময় আসবে প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকার শিক্ষা কুরবানিই দেয় প্রতি বছর। যেই কুরবানীর পরীক্ষায় কামিয়াব হয়েছিলেন হযরত ইবরাহিম (আ.)।যুগেযুগে আল্লাহর অগণিত প্রিয় বান্দা। কুরআন কারীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, কখনো আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোশত এবং রক্ত বরং পৌছায় তোমাদের তাকওয়া (সুরা আল হাজ্জ আয়াত-৩৭)।
শুধু পশু নয়, মনের পশুত্বের কুরবানি দিতে হয়। আমরা যে তিন প্রকারের নফসের কথা জানি তারমধ্যে প্রতিটি মানুষের ভেতর নফসে আম্মারা নামক একটি হিংস্র পশুত্বের নফস আছে। যে প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজে আকৃষ্ট করতে থাকে এবং মানুষের আত্মাকে পাপিষ্ঠ আত্মায় পরিণত করে।যেমন কুরআনে বলা হয়েছে, ' নিশ্চয় নাফস মন্দ কজের নির্দেশ দিয়ে থাকে।' (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫২)।এখানে মনে রাখা জরুরী নফস মূলত একটি এবং তা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করায় আলাদা নামকরণ করা হয়েছে। সে হিসেবে নফস প্রধানত তিন প্রকার।নফসে আম্মারা বা খারাপ আত্মা মানুষকে খারাপ কাজে প্ররোচনা দেয়। মানুষকে পশুর বৈশিষ্ট্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করায়। এটাই হলো পাপিষ্ঠ আত্মা।যে মানুষের অন্তরাত্মা পাপে ভরা, যেটার সম্মিলিত নামই পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ঠ আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকে আমাদের কুরবানি করা উচিত। প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে যেমন মনুষত্ব আছে, তেমনি পশুত্বও আছে।প্রতিবছর এ কুরবানির মাধ্যমে মনের পশুত্বকে হত্যা করে ভেতরে সুপ্ত মানবিক মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা হয়। আমাদের মনের যাবতীয় লোভ-লালসা, হিংসা বিদ্বেষ অহমিকা তথা ষড়রিপুর দমন এবং পাশবিক হিংস্র চরিত্র বর্জন করে মানবীয় গুণাবলীতে উজ্জীবিত হতে পারলেই আমাদের কুরবানি স্বার্থক হবে। ভবিষ্যতে যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের এই মানবীয় গুনাবলী তথা আত্মত্যাগ জাতির দুর্দিনে কাজে লাগতে পারে।
কুরবানীর ইতিহাস ঘেটে জানা যায় আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.)এর দুই পুত্র হাবিল এবং কাবিলের কুরবানির মাধ্যমেই কুরবানি প্রথা চালু হয়েছিল। হাবিল পৃথিবীর প্রথম মানুষ যে আল্লাহর রাহে একটি পশু কুুরবানি করেছিলেন ।তাফসীরে ইবনে কাসিরের বর্ণনা মতে, হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিয়দংশ আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবান করে।।তৎকালীন সময়ে কুরবানির পদ্ধতি ছিল যে আকাশ থেকে আগুন এসে কুরবানী কবুল করতো।এর ধারাবাহিকতায়, আগুন নেমে আসে এবং হাবিলের জবেহকৃত পশুটির কুরবানী কবুল করে। অপরদিকে কাবিলের কুরবানিকৃত ফসল প্রত্যাখ্যান করে। এ ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে, 'আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা ভয়েই কিছু কুরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানি গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি'। (সূরা মায়িদা : আয়াত ২৭)। মাঝে মাঝে চিন্তা হয় আজো যদি হাবিল কাবিলের কুরবানির ধারা প্রচলিত থাকতো তাহলে সমাজের মুখোশধারী কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হতো। যারা খুব বড় গলায় বড় কথা বলে বেড়ায়। তাদের চরিত্র সবার সামনে দৃশ্যমান হতো। এই সেই নেতা, এই সেই হুজুর যার কুরবানি আল্লাহ কবুল করেননি। চতুর্দিকে রটে যেতো। ভাগ্যিস আল্লাহ পাক এ বিধান বাতিল করে দিয়েছেন।
আমরা যারা কুরবানি দিচ্ছি আল্লাহ আমাদের মনের অবস্থা সমন্ধেও ওয়াকিবহাল। সব নবি রাসূলের ওপরেই কুরবানির হুকুম ছিল।সর্বশেষ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর কুরবানি ছিল মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কুরবানি এবং তা আজো বিশ্বের মুসলমানরা অনুসরণ করে চলছেন এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত তার কুরবানি প্রথা জারি থাকবে। হযরত ইবরাহিম আ তার জীবদ্দশায় অসংখ্য পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন। নমরুদ হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে হত্যার করার জন্য বিশাল অগ্নিকন্ডু তৈরী করেছিল।সেই জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখায় ইবরাহিম (আ.) কে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশে আগুন ঠান্ডা হয়ে গেল। আগুন হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর একটি পশম পুড়তে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বাঁচালেন, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ আল্লাহ তায়ালা বললেন 'হে আগুন' ইব্রাহীমের জন্য তুমি ঠান্ডা হয়ে যাও আরামদায়ক হয়ে যাও। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৬৯)
একদিন ইব্রাহীম (আ.) এর আরো পরীক্ষার সময় এলো আল্লাহ তায়ালা আদেশ করলেন হে ইব্রাহিম আ শিশু পুত্র ইসমাঈল ও তার মা হাজেরাকে নির্বাসনে দিয়ে আসো। হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে জনমানবহীন পাহাড় ঘেরা মরু উপত্যকা মক্কায় নির্জন ভুমিতে রেখে আসলেন। পরীক্ষা শেষ হয়নি হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্র ইসমাঈল (আ.) কে বলেন! হে পুত্র; স্বপ্নে দেখলাম আমি তোমাকে কুরবানি করছি। তুমি কী বল? তখন পুত্র ইসমাঈল কোন প্রকারে বিচলিত না হয়ে আনন্দ চিত্তে জবাব দিলেন ।' হে পিতা, আপনি যা করতে আদেশ প্রাপ্ত হয়েছেন তাই করুন। ইনশাল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে পাবেন'। (সূরা. আস সাফফাত আয়াত-১০২)। ৮৬ বছর বয়সে পুত্র সন্তানের জনক হলেন হযরত ইবরাহিম( আ,) পুত্র ইসমাঈল কতই না মায়া আদরের ছিলেন! কিন্তু ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনে পিছপা হননি। আল্লাহর অশেষ রহমতে সেদিন ইবরাহিম (আ.)এর সেই ত্যাগ তিতিক্ষার পরীক্ষায় সফলকাম হয়েছিলেনন। সেই ত্যাগেই উজ্জীবিত হওয়া আমাদের জন্য কর্তব্য। আমরা সেই ত্যাগের ইতিহাসকে মাংস রুটি খাবারের উৎসবে পরিণত করেছি। বড়ই অাফসোস আমরা ঈদুল আজহার প্রকৃত ইতিহাস ও শিক্ষা বেমালুম ভুলে আছি।
কুরবানি শুধু পশু জবাইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আল কোরআনের তিনটি জায়গায় কুরবানির উল্লেখ আছে যার একটি পশু কুরবানির ক্ষেত্রে এবং বাকি দুটি সাধারণ ভাবনার কাজ বোঝাতে যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।আল্লাহর পথে জীবন বিলিয়ে শহীদ হওয়া বোঝাতেও কুরবানি শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ব্যক্তির ধন সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে দেওয়াকেও কুরবানি বলা হয়ে থাকে। সুতরাং কুরবানি হতে পারে-সম্পদের, সময়ের, স্বার্থের, সামথ্যের, ইচ্ছার, জানের, মালের, ও পশু জবাইয়ের।তাই বলতে পারি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের স্বার্থ, মাল সামানা ও আত্ম উৎসর্গের মহিমাই হলো কুরবানি।পরাধীনতার যাঁতাকল ছিন্ন করে মুক্ত হওয়ার জন্যে যে আত্ম ত্যাগের প্রয়োজন। সে জন্যে ইব্রাহিমের মতো পুত্র কুরবানি হতে পারে প্রয়োজন। জাতির জন্যে হাজেরার মতো মায়ের আজ খুব প্রয়োজন। তবেই স্বাধীনতার স্বাদ পূর্ণ হবে।কবি নজরুল ইসলাম বলেন,
'আস্তানা সিধা রাস্তানয়
আযাদি মেলেনা পস্তানোয়
দস্তা নয় সে সস্তা নয়’।
হযরত ইবরাহিম ( আ.)-এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান এ দিনটি শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত ভালোবাসা ধনে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগেই সব সুখ। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। ঈদুল আজহার এই অর্থ নয় শুধু পশু হত্যা, বরং আত্মত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার। নজরুলতো সেই কথাই বলেছেন তাঁর ‘কোরবাণী’ কবিতায়-
'ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যগ্রহ’শক্তির উদ্বোধন
দূর্বল ভীরু চুপরহো ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন '।
আল্লাহ পাক কুরবানি প্রথা কিয়ামত পর্যন্ত চালু রাখলেন। এ ধারাবাহিকতায় আমাদের এ পশু কুরবানি। আমাদের জীবনে এ শিক্ষা গ্রহণ করলে আমরা হয়ে উঠবাে একে অপরের প্রতি সহানুভুতিশীল, পরোপকারী ও আত্মত্যাগী, আত্মত্যাগী মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ বয়ে আনে। নিজের সুখ শান্তির বাইরে যারা সমাজের মানুষের সুখকে বড় করে দেখে তারাই প্রকৃত মানুষ, কুরবানি ত্যাগের এটাই শিক্ষা।ঈদ-উল-আযহা বা কুরবানির ঈদের তাৎপর্য খুজে পেয়েছেন নজরুল ।সেটাই তিনি তার ‘বকরীদ’ কবিতায় বলতে চেয়েছেন,
শহীদানদের ঈদ এলো বকরীদ
অন্তরে চির নৌ-জোয়ান যে তারি তরে এই ঈদ,
আল্লার রাহে দিতে পারে যারা আপনারে কুরবান
নির্লোভ নিরহংকার যারা যাহারা নিরভিমান
দানব দৈত্যে কতল করিতে আসে তলোয়ার লয়ে
ফিরদাউস হতে এসেছে যাহারা ধরায় মানুষ হয়ে
অসুন্দর ও অত্যাচারীরে বিনাস করিতে যারা
জন্ম লয়েছে চির-নির্ভিক, যৌবন মাতোয়ারা
তাহাদেরি শুধু আছে অধিকার ঈদগাহে ময়দানে
তাহারাই শুধু বকরিদ করে জান-মাল কুরবানে।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক