২৫ জুলাই ২০১৯, ১৩:৪৭

‘ছেলেধরা গুজব’ এভাবে আর কত?

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত বিষয় ‘ছেলেধরা’ গুজব।গত কয়েকদিনে দেশজুড়ে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছে।সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার উত্তর বাড্ডায়। তাসলিমা আক্তার রেণু নামের যে মহিলাটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে তিনি গিয়েছিলেন পাশ্ববর্তী একটি স্কুলে তার সন্তানকে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার জন্য।কিন্তু কিছু হিংস্র মানুষরুপী জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি।ভদ্র মহিলার বাড়ী আমার নিজ উপজেলায়। আমার ইউনিয়নের দু ইউনিয়ন পরেই। ব্যাক্তিগতভাবে উনাকে চিনি না। কখনও দেখিও নি।

এটা ঠিক আমাদের অঞ্চলটা অন্যান্য অঞ্চল থেকে একটু শান্ত।এই মহিলা জীবনেও হয়তো এ ধরনের ঘটনা কোথাও ঘটেছে শুনেও নি দেখা থাক দূরের কথা।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দিনে দুপুরে শত শত মানুষের সামনে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেললো! কিভাবে পারলো!

ছোট বেলা থেকে আমরা শিখে আসছি বড়দের সন্মান করতে। তাদের কথা মানতে হবে। আর বিশেষ করে নারীদের অবশ্যই সন্মান করতে হবে।কারণ তারা মায়ের জাতি।কিন্তু কোথায় আমাদের সেই শিক্ষা?

আমরা প্রায় সময়ই অনেককে বলতে শুনি এমনকি পাবলিক পরিবহনে উঠলে অনেক ঝগড়াঝাটি দেখি নারীদের জন্য নির্ধারিত আসনে পুরুষদের বসা নিয়ে।অনেককেই দেখেছি মহিলাদের জন্য নির্ধারিত আসন না হওয়া সত্ত্বেও তার আসনখানা দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে ছেড়ে দিতে।এটা তাদের প্রতি করুণা নয় বরং সন্মান থেকে।এবং এটাই আমাদের চিরায়িত চরিত্র।

কতটা মানবতা বিবর্জিত অমানুষ হলে একজন নারীকে এভাবে মেরে ফেলতে পারে? সে একজন নারী সে একজন মানুষ।মানুষ আমরা সৃষ্টির সেরা জীব।একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করা এটা কোন সভ্য সমাজের কাজ নয়।সংবাদপত্রের তথঢ অনুযায়ী এ পর্যন্ত ১৫ জেলায় ৭ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়েছে।আমি যে জেলায় কর্মরত এখানেও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে।

রেণু হত্যার আসামীদের ধরা হচ্ছে। হয়তো তাদের বিচারও হবে।কিন্তু যে সন্তানগুলো তাদের মাকে হারালো তাদের কি হবে?আমরা কি জবাব দিবো তাদের কাছে?এ সন্তানগুলো যখন বড় হয়ে বুঝবে মানুষ রুপী কিছু হায়েনা তাদের মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তখন এই সমাজ সভ্যতার প্রতি তাদের মনোভাব কি হবে?

তাপস পাল।প্রাথমিক শিক্ষা চট্টগ্রাম বিভাগীয় অফিসের একজন কর্মকর্তা। ব্যাক্তিগতভাবে স্যারকে আমি চিনি। বিভিন্ন সভা সেমিনারে কিংবা স্যারের অফিসেও দেখা হয়েছে বহুবার। অত্যন্ত মিষ্টভাষী একজন মানুষ। গিয়েছিলেন একটা স্কুল পরিদর্শন করতে। কিন্তু অপরিচিত হওয়ায় অনেকেই স্যারকে চিনতে পারেনি। না চিনতে পারাটাই স্বাভাবিক,কারণ একজন বিভাগীয় কর্মকর্তা একটা বিদ্যালয়ে খুব বেশি যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই খুব একটা পরিচিতি ও থাকে না। তাই বলে তিনি ছেলেধরা? অপরিচিত কাউকে দেখলেই তিনি ছেলেধরা এটা কি ধরনের কথা?

প্রাথমিক ছাড়াও বিভিন্ন দপ্তরের কমকর্তাগনকে বিদ্যালয় পরিদর্শনের নির্দেশনা দেয়া আছে। অনেকেই আকষ্মিক পরিদর্শন করেন। কিন্তু এ ধরণের অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া এটা শুধু লজ্জাকরই না অশনি সংকেতও বটে। তাছাড়া একজন কর্মকর্তাকে দেখেই তো মার্জিত মনে হয়। তার ড্রেসআপ দেখলেই তো অনুমান করা যায়। এটা আসলে আমাদের বিকৃত মস্তিষ্কের কারণে হচ্ছে।

কি বাজে পরিস্থিতি চিন্তা করা যায়? আমরা যারা গুজব পতিরোধে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি তাদেরকেই এ ধরনের অপবাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্যার একটা স্কুলের লোকেশান জানতে চেয়েছেন হয়তো। আমিও একজন ফিল্ড লেভেলের কর্মকর্তা। বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলি। আমার মতো এ রকম কয়েক হাজার পাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন যারা নিয়মিত বিদ্যালয় পরিদর্শন করে থাকেন।

বেশিরভাগ জায়গাই আমাদের অপরিচিত। মাঠঘাট পেরিয়ে দূর বহুদূর স্কুল পরিদর্শন করতে হয়। নতুন পরিবেশ, নতুন অভিজ্ঞতা হয়। অনেক সময় কাউকে ডেকে লোকেশন জানতে চাই। এখন তো ভয় হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করতেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

মাসের প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন স্কুলে পরিদর্শনে যাওয়া হয়।শিশুদের সাথে থাকতে, একটু গল্প করতে, তাদের একটু নতুন কিছু শেখিয়ে মজা পাই।আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই ২য় সাময়িক পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।রোজার বন্ধের পর এবার খুব একটা সময় পাওয়া যায়নি।তার উপরে ছেলেধরা গুজবে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি অনেক কমে গেছে।

শেষ ১৫ দিনে অনেকগুলো মা সমাবেশ করেছি। মায়েদের বুঝিয়েছি। কিন্তু তাদের একটাই কথা, ‘পোলাপানের মনের ভিতর ভয় ঢুকে গেছে’। একযোগে সকল স্কুলে মা সমাবেশ করেও মায়েদের গুজবে কান না দিতে সচেতন করছি। কিন্তু এই কয়দিন যারা নিয়মিত স্কুলে যায়নি তাদের যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গেলো তার দায়ভারকে নিবে?

এ ধরনের মিথ্যাগুজব রটানো দন্ডনীয় অপরাধ।পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে এ ধরণের গুজব যারা রটালো তাদের বিরুদ্ধে দ্রুতবিচার আইনে ব্যাবস্থা নেওয়া জরুরী।

লেখক : মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
naforhad.du@gmail.com