জিপিএ-৫ বনাম কোয়ালিটি এ্যাডুকেশন
গতকালই প্রকাশ হয়ে গেল ২০১৯ সালের উচ্চ মাধ্যামিক পরীক্ষার ফলাফল। আজ কিছু জাতীয় দৈনিক এবং চাঁদপুরের স্থানীয় পত্রিকায় ফলাফল সংক্রান্ত নিউজ দেখে বিভ্রান্তিতে পড়লাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন জিপিএ-৫ ই সবকিছু নয়। কতটুকু মানুষ হতে পারলে সেটাই আসল বিষয়। কিন্তু আমরা কি দেখছি ? ছাত্র শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক সবাই ছুটছি জিপিএ-৫ এর পেছনে। এই যে দুরন্তপনায় ছোটাছোটি সেটা একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছাড়া কিছু নয়। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই জিপিএ-৫ ই গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করে না। বলতে পারবেন জিপিএ-৫ পাওয়া কতজন ছাত্র ছাত্রী বুয়েট মেডিকেল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান করে নিতে সক্ষম হচ্ছে? পরিসংখ্যানটা কি কারো কাছে আছে?
আজকের পত্রিকার ফলাফলের বিশ্লেষণ দেখে কিছু প্রশ্নের অবতারণা করতে হয়।
১। শতভাগ পাশ করা প্রতিষ্ঠান বা ৮০%-৯০% পাশ করা প্রতিষ্ঠান কি প্রতিষ্ঠানের ভাল ফলাফল নিশ্চিত করে? আমি বলবো অবশ্যই না। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়ে ৪৮ জন পাশ করলো মানে পাশের হার ৯৬%। আর কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০০ ছাত্র ছাত্রী পরীক্ষা দিয়ে ৪৮০ জন পাশ করে পাশের হার ৯৬% হলো। দুটি প্রতিষ্ঠানকে কি একই কাতারে ফেলবেন? একটা গল্পই বলি। ছেলেটি বাড়ীতে এসে বললো আমি ক্লাসে ১ম হয়েছি। বাবা জিজ্ঞেস করলো তোমার ক্লাসে ছাত্র কতজন। সে বললো আমি একাই। ৫০জনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়টি অনেকটা এমনই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ১০০০ ছাত্রের পাশের হার ৯০% আর ১০০ ছাত্রের পাশের হার ৯০% একই হলো না। সেরা প্রতিষ্ঠান যখন চিহ্নিত করা হয় তখন শুধু মাত্র পাশের হার বা জিপিএ-৫ ই নির্ধারক নয়। তার সাথে আনুসঙ্কিক অনেক কিছুকে বিবেচনায় আনা হয়।
২। এই চাঁদপুরেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেখলাম পাশের হার ৯০% এর উপর। কিন্তু তাদের কেন্দ্রটি ভেন্যু কেন্দ্র। ভেন্যু কেন্দ্র নিয়ে নানা রকম আলোচনা, মুখরোচক কথা প্রচলিত রয়েছে। কোন অবস্থাতেই ভেন্যু কেন্দ্রের রেজাল্ট আর যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ছাত্র পরিবর্তিত হয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দেয় তার রেজাল্ট একই মাপকাঠিতে হতে পারে না। ভেন্যু কেন্দ্রগুলোতে কি হয় সেটা ছাত্র শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সকলেরই জানা রয়েছে। পরীক্ষার ফলাফলের সমতা বিধান করার জন্য বা পরীক্ষা গ্রহণের বৈষম্য দুর করার জন্য ইতিমধ্যে ভেন্যু কেন্দ্র তুলে দেবার দাবী উঠেছে। সকলকে বিনয়ের সাথে বলবো ভ্যেনু কেন্দ্রের সাথে ছাত্র পরিবর্তিত কেন্দ্রের তুলনা করা ইনজাস্টিস হবে।
৩। জিপিএ-৫ এ সেরা এই প্রতিষ্ঠান, ঐ প্রতিষ্ঠানে জিপিএ-৫ পায়নি। এমন বিশ্লেষণ যখন দেখি তখন ভাবি আমার সাংবাদিক বন্ধুরা মুদ্রার একপীঠ দেখেই বিশ্লেষণ করেন। আমি আমার সাংবাদিক বন্ধুদের বিনয়ের সাথে বলবো একটু খবর নিন কোন প্রতিষ্ঠানে এসএসসিতে জিপিএ-৫ কতজন ভর্তি হয়েছে আর কতজন জিপিএ-৫ পেয়ে বের হয়ে এসেছে। যারা জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হলো তারা সবাই জিপিএ-৫ পেলনা কেন? সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। মনে করুন কোন প্রতিষ্ঠানে জিপিএ-৫ ভর্তি হলো ২৫০ জন কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৫০ জন। এটাকে আপনারা কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন ? আবার কোন প্রতিষ্ঠানে জিপিএ-৫ একজনও ভর্তি হয়নি। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১০ জন। কোন প্রতিষ্ঠানকে আপনি ক্রেডিট দেবেন? সেটাও বিশ্লেষণের দাবী রাখে।
৪। প্রতিষ্ঠানে কি মানের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হলো সেটা আরেকটি বিষয়। যে প্রতিষ্ঠানে কোন ছাত্র -ছাত্রীই জিপিএ ৪.৫ এর নীচে ভর্তি হয়নি আর যে প্রতিষ্ঠানে জিপিএ ৩.০০ থেকে ২.০০ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়ে যে রেজাল্ট করলো তার পাশের হার কেমন হওয়া উচিত? প্রথমটির পাশের হার যদি হয় ৮০% এবং দ্বিতীয়টির পাশের হার হয় যদি ৭০% কোনটাকে আপনি ভাল রেজাল্ট বলবেন? নামী দামী কলেজগুলোতে ১০০% ছেলে জিপিএ-৫ নিয়ে ভর্তি হয়। তাদের একজন ছাত্রও ফেল করার কথা নয়। কিন্তু তাদের পাশের হার ৯৫% হলে সেটা কি চোখে দেখবেন?
সমাজের সকলকে বলবো বিষয়গুলো একপেশে না দেখে দিব্য চক্ষু দিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। পাশের হার বা জিপিএ৫ ই সবকিছু নয়। আমরা একজন ছাত্রকে কতটুকু মানুষ করে গড়ে তুলতে পারলাম সেটা বড় বিষয় হওয়া উচিত। প্রতিষ্ঠানকে মূল্যায়ন করা উচিত সে প্রতিষ্ঠানটি কতটুকু শিক্ষা বান্ধব, কতটুকু পরিবেশ বান্ধব। কতটুকু শিক্ষার্থী বান্ধব। এই শহরে এমনও প্রতিষ্ঠান আছে যারা শিক্ষাকে বাণিজ্যিকিকরণ করেছে। উচ্চ হারে বেতন ফি নিচ্ছে। ভর্তিতে নির্ধারিত ফি এর দশগুন বেশী নিচ্ছে সেটাকে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলবেন নাকি কোচিং সেন্টার বলবেন?
শিক্ষার মান বিশ্লেষণ করতে হলে সবকিছু বিবেচনায় এনে বিশ্লেষণ করতে হবে। নতুব কারো প্রতি অবিচার হয়ে যাবে।
লেখক: রতন কুমার মজুমদার
অধ্যক্ষ, পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজ, চাঁদপুর।
(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)