০৫ জুলাই ২০১৯, ২০:৫২

ক্রিকেটে মাশরাফির দিন কি ফুরিয়ে যাচ্ছে?

  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে মাশরাফি বিন মর্তুজা একজন জীবন্ত কিংবদন্তির নাম। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা পেসার নড়াইল এক্সপ্রেস খ্যাত তিনি। তার জন্য বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে হৃদয় উৎসারিত অশেষ ভালোবাসা। মাশরাফিকে জড়িয়ে আমাদের আছে কত আবেগ! কত উচ্ছ্বাস! তা বর্ণনাতীত। যে মুহূর্তে আমি লেখাটি লিখছি ঠিক সে মুহূর্তে মাশরাফি তার ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন।

এই পাকিস্তানকেই বাংলাদেশ প্রথমবারে অংশ নেওয়া সপ্তম বিশ্বকাপে পরাজিত করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সেসময় মাশরাফি দলে ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে মাশরাফির নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিকাংশ অর্জন সম্ভব হয়েছে। সেই সময়ে টগবগে তরুণ মাশরাফি ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নেন। দ্বাদশ বিশ্বকাপ তথা আজকের খেলার মধ্য দিয়ে মাশরাফির বিশ্বকাপ আসরে বিদায় ঘন্টা বেজে উঠবে। লাল সবুজের জার্সি গায়ে তাঁকে আর কোনো বিশ্বকাপ আসরে দেখা যাবে না।

তবে এই বিশ্বকাপে মাশরাফির জন্য সুখকর ছিল না। তার দক্ষ অধিনায়কত্বে আমরা এ পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ জিতলেও মাশরাফির ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। ২০০৭’র বিশ্বকাপে একাই ৪ উইকেট নিয়ে ভারতকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ২৩ বছরের মাশরাফি। কিন্তু এখন সেই মাশরাফি শুধুই যেন সেই দিনের ছায়া।

এবারের বিশ্বকাপে বিগত সাতটি ম্যাচে ৪৯ ওভার তথা ২৯৪ টি বৈধ বল ডেলিভারি করে তিনি দিয়েছেন ৩১৫ রান। পেয়েছেন ১ টি উইকেট। ৪টি ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে করেছেন ২১ বলে ১৯ রান। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও চলছে ব্যাপক সমালোচনা। ১০ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে সব মিলিয়ে করেছেন ১৯ রান।

ব্যাট-বল সব বিভাগেই ব্যর্থ তিনি। ৩৫ বছরের মাশরাফিকে শুধুমাত্র অধিনায়ক হিসেবে দলে রেখে বাংলাদেশ হয়তো দল হিসেবেও ভুগছে। কারণ মাশরাফি খেলা মানে কার্যত দশ জনে খেলছে টাইগাররা।

দ্বাদশ বিশ্বকাপে আসার আগেও ফর্মে ছিলেন না মাশরাফি। নিয়মিত উইকেটও পাচ্ছিলেন না। দলে আরও বোলার থাকলেও অধিনায়ক মাশরাফিই শুরু করছেন বারবার এবং ব্যর্থ হচ্ছেন। এই জায়গাটা নিয়ে এবার নতুন করে ভাবতেই হবে বাংলাদেশকে।

মাশরাফি আপনি পায়ে সাতটি অপারেশন নিয়ে এখনো খেলছেন। আপনার পরিশ্রম, দক্ষতা, অধিনায়কত্বের তুলনা হয় না। আপনার দেশপ্রেম, দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা অনুকরণীয়। মাশরাফি আপনি অনেক দিয়েছেন দেশকে। এখন হয়তো ব্যাট-বল হাতে জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারবেন না।

এ বিশ্বকাপের পর হয়তো আপনি অধিনায়কত্ব ছাড়বেন। দলের একজন সাধারণ খেলোয়াড় হয়ে খেলবেন। কিন্তু হিরোদের যশ খ্যাতি থাকাবস্থায় কি চলে যাওয়াটা বেটার না? নতুনদের কি সুযোগ করে দেওয়া আপনার উচিত নয়? আপনি তো এখন একই সঙ্গে অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য। আমার মতে একই সঙ্গে দুটো পদ পাওয়া বিশ্বের ইতিহাসে আপনি একজনই। এক্ষেত্রে আপনি বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।

মাশরাফিকে খুব বেশি ভালোবাসি। তাঁর একজন ভক্তও বটে। যেদিন রাজনীতিতে তাঁর অভিষেক হলো সেদিন খুব বেশি ব্যথিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশের তারুণ্যের অহংকার তিনি। তার বিনয় নম্রতা নিরহংকার চরিত্রে সবাই মোটামুটি মুগ্ধ। বাংলাদেশের কলুষিত রাজনীতিতে তিনি হতে পারতেন বিকল্প একটি প্লাটফর্ম। যেখানে তারুণ্যের ভাগ্যাকাশের কালো ঘনঘটার পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি দূষিত পানির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন। বর্তমানের নোংরা রাজনীতির দুর্গন্ধ কিছুটা তাকেও স্পর্শ করবে এবং ব্যর্থতা তাঁর স্কন্ধেও বর্তাবে।

কিছুদিন আগে ডাক্তারদের চিকিৎসায় অবহেলা এবং তৎপরবর্তীতে তাঁর তৎপরতায় তাকে তির্যক বিতর্কের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। বিশ্বকাপে সাত ম্যাচে এক উইকেট পেয়ে তিনি এখনো দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্য কোনো দেশ হলো বিকল্প কেউ নেতৃত্ব আসতো কিংবা নিজেই মান-সম্মান বজায় রেখে দল থেকে পদত্যাগ করতেন। আমাদের দেশে অবশ্য এসব বিরল ও অকল্পনীয় ব্যাপার। কেউ পদ ছাড়তে চায় না। হাজারো অকাম-বদকাম দুর্নীতি কিংবা অদক্ষতার পরিচয় দিলেও। পাবলিককেই আন্দোলন করে টেনে হেঁচড়ে নামাতে হয়।

যাকগে আজকের ম্যাচের পর বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশনের সমাপ্তি। অনেকেই দলে থাকবেন না। হয়তো তারুণ্য নির্ভর দল গঠিত হবে আবার। এরপর মাশরাফির উচিত হবে জনগণের ভালোবাসা ও সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অধিনায়কের পদ ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে মনোনিবেশ করা। এখন ক্রিকেটের বাইশ গজ পিচে তিনি বড্ড বেমানান। মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য অনেক দিয়েছেন যা জাতি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে করবে। তিনি এখন মাননীয় এমপি সামনে মন্ত্রী হতে পারেন কি না সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।

দেশের জনগণের সেবার জন্য উচ্চ নেতৃত্বের সমাসীন হওয়া প্রয়োজন। আবার বলি হিরোদের হিরো থাকাবস্থায় বিদায় নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। মানির মানটাই অনেক কিছু। সবশেষে বলি ভালোবাসি মাশরাফি। এ ভালোবাসাটা চিরদিনের জন্য। আপনি যেভাবে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এমনিভাবে দাঁড়িয়ে যান সুখে-দুঃখে এদেশের মানুষের পাশে। এভাবে আপনি জাতির হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

সুকান্ত বাবুর কবিতা দিয়ে শেষ করি-

‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে
ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর
ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।’