এমপিওভুক্তির চূড়ান্ত ফয়সালা দরকার: শরীফুজ্জামান আগা খান
অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতার কারণে বাজেট বক্তৃতার অর্ধেকটা প্রধানমন্ত্রী পাঠ করে শোনান। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখার বিষয়টি পাঠকালে প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দেন। এ সময় সংসদে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের ভেতর আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে। তারা অধীরভাবে এমপিওভুক্তির ঘোষণার অপেক্ষায় আছেন।
গত অর্থবছরে এমপিওভুক্তির জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সেইসঙ্গে অর্থের অপ্রতুলতার কারণে এমপিওভুক্তির ঘোষণা আর আসেনি। এ বছর সদিচ্ছার লক্ষণ এবং বরাদ্দ বাড়ায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে বলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বিশ্বাস।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের পর আবেদন করলে নানাদিক বিবেচনার পর স্বীকৃতি মেলে। এ যাবৎকাল স্বীকৃতিকেই মানদণ্ড ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এবারে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণে প্রণীত নীতিমালা এবং ত্রুটিপূর্ণ স্কোরিং পদ্ধতি অনুসরণ করে এমপিওভুক্তির যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে করে অনেক সম্ভাবনাময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওর বাইরে থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নীতিমালায় মফস্বলে নিু মাধ্যমিক (৬ষ্ঠ-৮ম) বালিকা বিদ্যালয়ের কাম্য শিক্ষার্থী ধরা হয়েছে ১২০ জন অথচ মাধ্যমিকে (৬ষ্ঠ-১০ম) এ সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে ১০০ জন। আবার মফস্বলে নিু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কাম্য শিক্ষার্থী ধরা হয়েছে ১৫০ জন।
অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ সংখ্যা ২০০ জন। তাহলে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী বাড়ছে ৫০ জন। প্রতি শ্রেণীতে গড় শিক্ষার্থী ২৫ জন। অথচ এসএসসি পরীক্ষার জন্য কাম্য পরীক্ষার্থী চাওয়া হয়েছে ৪০ জন।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সমমানের দাখিল মাদ্রাসার শর্তপূরণের পার্থক্যও চোখে পড়ার মতো। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এসএসসি পরীক্ষায় কাম্য পরীক্ষার্থী ৪০ জন আর পাসের হার ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ অন্তত ২৮ জন পরীক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ হতে হবে। অন্যদিকে দাখিল মাদ্রাসার কাম্য পরীক্ষার্থী ২০ জন আর পাসের হার ৬০ শতাংশ। মাদ্রাসার ক্ষেত্রে ১২ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেই চলছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নির্ধারণের জন্য ৪টি সূচকে স্কোরিং করা হয়েছে। প্রতিটি সূচকের মান ২৫। এর ভেতর ন্যূনতম ১৫ পেলে তবেই স্কোর ধর্তব্যের ভেতর পড়েছে। বিষয়টি এরকম, ১০০-এর ভেতর ৬০-এর নিচে যে নম্বরই পাক না কেন পরীক্ষার্থী, ০ (শূন্য) পেয়েছে। ১ থেকে স্কোরিং না করায় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মান এ পদ্ধতিতে মিলবে না।
স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে চতুর্দিকে সমজাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব এবং কাছের এলাকার জনসংখ্যার হিসাবের প্রয়োজন পড়েছে। এ দুই ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পরিসংখ্যান কর্মকর্তার কাছ থেকে সনদ নিতে হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে এ দুটি শর্ত পূরণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এমপিওভুক্তির নীতিমালায় এ দুটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, এমপিওভুক্তির ৯ হাজারের বেশি আবেদনের ভেতর প্রাথমিকভাবে ২ হাজার ৭৬২টি প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীন স্কুল ও কলেজ ১ হাজার ৬২৯টি। কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের অধীনে মাদ্রাসা ৫৫১টি এবং কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৫৮২টি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া প্রকাশ করা হয়নি। ৪টি সূচকে ন্যূনতম মান অর্জন করলে সব প্রতিষ্ঠানই কি যোগ্য বিবেচিত হয়েছে? নাকি এখানেও বাজেটের প্রাপ্তিসাপেক্ষে উপরের দিককার প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে?
কোনো একটি প্রতিষ্ঠান ৩টি মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হলেও একটিতে অল্পের জন্য পিছিয়ে পড়লে কি অযোগ্যের কাতারে ফেলা হয়েছে? যোগ্য বিবেচিতর ভেতর কত সংখ্যক সম্পূর্ণ নন-এমপিও আর কত সংখ্যকই বা স্তর পরিবর্তন প্রতিষ্ঠান রয়েছে? অনলাইনের আবেদনে সংসদীয় এলাকার উল্লেখ ছিল।
কোনো সংসদীয় এলাকায় অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠান থাকলে সবই কি এমপিওভুক্ত হবে? আবার কোনো সংসদীয় এলাকায় একটিও যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকলে কি কোনো প্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্ত হবে না? এমপিওপ্রত্যাশী শিক্ষক-কর্মচারীদের ভেতর এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিওভুক্তির প্রধান স্টেকহোল্ডার। এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়ায় তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকাই ছিল সঙ্গত। তাহলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুবিধা-অসুবিধা জেনে অধিকতর বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যেত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এমপিওভুক্তির কমিটিতে নন-এমপিও শিক্ষকদের প্রতিনিধি রাখা হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদস্থরা বলছেন, এবারে যোগ্যতা অর্জন করতে না পারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরবর্তী সময়ে যোগ্যতা অর্জন করলে তখন এমপিও পাবে। কিন্তু নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা কঠিন।
২০১০ সালে এমপিওভুক্তির পর সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া চলমান থাকার কথা বলেছিলেন; কিন্তু তার মন্ত্রিত্বকালে সেই প্রক্রিয়া আর চলমান থাকেনি। ২০০৪ সালের ৬ বছর পর ২০১০ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি করা হয়।
এরপর দীর্ঘ ৯ বছর পর ২০১৯ সালে এমপিওভুক্তি হতে যাচ্ছে। এরকম কালক্রম বজায় থাকলে পরবর্তী সময়ে হয়তো ১২ বছর পর ২০৩১ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে। কাজেই এবারে না হলে অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে এমপিওভুক্ত হবে, নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা সেই ভরসা পাবেন না।
তাদের ভেতর হতাশা দেখা দেবে। অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে বিকল্প জীবিকার সন্ধান করবেন। আর এই যে ভবিষ্যতে অধিকতর যোগ্যতা অর্জন করলে প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সান্ত্বনার কথা, বিরূপ পরিস্থিতির যোগ্যতা তো বাড়বেই না, অধিকন্তু এখন যে যোগ্যতা রয়েছে তা-ও পড়ে যাবে।
কোনো একটি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেস স্টাডি করলে দেখা যাবে, প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠানটি ভালোই চলেছে। এরপর যত বছর গড়িয়েছে মানেরও ক্রমাগত অবনমন ঘটেছে। যথাসময়ে এমপিওভুক্ত হতে না পারাই এর প্রধান কারণ। এখানে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টির উল্লেখ করতে হয়।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানেও নিবন্ধনধারী শিক্ষক নিয়োগের বিধান করা হয়েছে। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অনেক শিক্ষক হতাশ হয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
মফস্বল এলাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দূরের একজন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের বিনা বেতনে কি নামমাত্র বেতনে চাকরি করা সম্ভব? দু-এক বছর চাকরি করার পর এমপিও না হওয়ায় হতাশ হয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। এতে করে মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক স্বল্পতা বিরাজ করছে। ফলে মানসম্মত পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। সে কারণে বছরের বছর অনিশ্চয়তায় না রেখে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা কিংবা না করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলছে এবং যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলেও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রয়োজন সেগুলোকে এমপিওভুক্ত করতে হবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই সেগুলোকে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় কিংবা বিলোপ করতে হবে।
নন-এমপিও শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে সবসময়ই একটি সার্বিক সমাধানের দাবি জানানো হয়েছে। এ জন্য বাজেট বরাদ্দ যথেষ্ট না হলে আংশিক বেতন নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দুই কী তিন বছরে বেতন সম্পূর্ণ হতে পারে। এ বছর এমপিওভুক্তি খাতে ১২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত বছরের অব্যবহৃত ৫শ’ কোটি টাকা রয়েছে। এ দু’বারের অর্থযোগে এবং প্রয়োজনে আরও কিছু বাজেট বাড়িয়ে এমপিওভুক্তির একটা সার্বিক সমাধান করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না- অভাব, হতাশা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা নিয়ে কোনো শিক্ষকের পক্ষে মানসম্মত পাঠদান করা সম্ভব হয় না।
শরীফুজ্জামান আগা খান : শিক্ষক ও গবেষক