২৩ জুন ১৭৫৭: উপমহাদেশের স্বাধীনতার কবর রচিত হওয়ার দিন
‘বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে। এমন কেউ কি আছে, যে বলবে আশা নয় দূর আশা।’ দেশের ভেতর ও বাইরের শতমুখী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা অসহায় হয়ে বলেছিলেন একথা। যা নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমায় অনেকে শুনে ও দেখে থাকবেন।
২৩ জুন ১৭৫৭ সাল। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিনটি অন্যসব দিনের চেয়ে ছিল কিছুটা আলাদা। ২৬২ বছর আগে এদিনে ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ পুরো উপমহাদেশের স্বাধীনতার কবর রচিত হয়েছিল। সিরাজের নানা আলীবর্দী খান ইন্তেকাল করেন ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল। নানা নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুতে বাংলার মসনদে আরোহণ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
সিরাজউদ্দৌলার বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই নবাব দেখেন চারিদিকে দেশীয় বণিক, বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজ বেনিয়াদের চক্রান্ত। যার পরিণতিতে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাস্ত হন। ফলে ১৯০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নদিয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ চক্র এই কালো দিবসের জন্ম দেয়। যুদ্ধক্ষেত্রে এই স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রীদের শিকার ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিপাহসালার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি বকসী মীরমদন, প্রধান আমাত্য মোহনলাল কাশ্মিরী ও নবে সিং হাজারী।
ঘৃণিত কলঙ্কজনক এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অধ্যায় সৃষ্টির পেছনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎ শেঠ, মীরজাফর, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ বা আমির চন্দ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ, ঘসেটি বেগমের ক্ষমতার লোভ। রাজা রাজবল্লভ, মহারাজ নন্দকুমার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রানী ভবানী প্রমুখের কৌশলী চক্রও এর পেছনে প্রচ্ছন্ন ছিল। ২২ জুন সকালে ব্রিটিশ বাহিনী ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশীর পথে যাত্রা করে। অবশ্য ২২ তারিখ দুপুরের পর পরই ক্লাইভ পলাশীর পথে তার যাত্রা অব্যাহত রেখে দুপুর রাতের পর সেখানে পৌঁছেন।
ইতোমধ্যে নবাব মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় ৬৫ হাজার সৈন্য নিয়ে রওয়ানা দেন এবং শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য পলাশীতে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। মীর মর্দান, মোহন লাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারী প্রমুখের অধীন নবাবের সেনা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালায়, অন্যদিকে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভরামের অধীনে নবাবের প্রায় ৪৫ হাজার সেনা নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও পরিস্থিতি অবলোকন করে। এমনকি বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরও চূড়ান্ত কিছু ঘটেনি। ক্লাইভ এমন প্রতিরোধ পাবেন কখনো আশাও করেননি।
জানা গিয়েছিল, দিনে যথাসম্ভব তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে ক্লাইভ রাতের অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলা মীর মদনকে আঘাত হানে এবং এতে মীর মদনের মৃত্যু হয়। মীর মদনের মৃত্যুতে হতভম্ব নবাব মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্য তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মীরজাফর নবাবকে ঐ দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং পরদিন সকালে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করার পরামর্শ দেয়। এ খবর শীঘ্র ক্লাইভের নিকট পৌঁছানো হয়েছিল।
পরামর্শ মোতাবেক নবাব যুদ্ধ বন্ধ করে, ফলে সেনানায়কেরা পিছু হটে। এই সুযোগে ইংরেজ সেনারা নতুন করে প্রচন্ড আক্রমণ চালায় এবং এতে নবাব বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়। বিকেল ৫টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে তখনই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন।
ইতিহাসবিদ ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দী করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেতো এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না। ইতিহাসবিদ মোবাশ্বের আলী তার ‘বাংলাদেশের সন্ধানে’ গ্রন্থে লিখেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রায় লাখ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্পসংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীর জাফরের মোনাফেকীতে।
ইতিহাসবিদ নিখিল নাথ রায়ের লেখা ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ থেকে জানা যায়, নবাবের সেনাবাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত। জনৈক ব্রিটিশ সৈন্য পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন, তার মতে ‘এটাই ছিল সেই বিশিষ্ট ও চূড়ান্ত যুদ্ধ যেখানে কোন ব্যাপক আক্রমণ ছাড়াই রাজ্য জয় করা হয়।’ পলাশীর ২৩ জুনের ইতিহাস প্রকৃত সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার ইতিহাস। ২৩ জুনের ইতিহাস বিশ্বাস ঘাতকতার ইতিহাস।
পলাশীর যুদ্ধের এই নৃশংস ও কলঙ্কজনক ঘটনার মাধ্যমে কলকাতাকেন্দ্রিক একটি নতুন উঠতি পুঁজিপতি শ্রেণী ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। ইংরেজ ও তাদের এ দেশীয় দালালগোষ্ঠী দেশবাসীর ওপর একের পর এক আগ্রাসন চালায়। ফলে দেশীয় কৃষ্টি-সৃংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে। যে ধারা এখনো প্রবাহমান।
এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল ধ্বংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এ যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলা ব্রিটিশদের অধিকারে চলে আসে। বাংলা অধিকারের পর ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষ এমনকি এশিয়ার অন্যান্য অংশও নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। বাংলা রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারায়।
সারা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলনে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষি ও তাঁতশিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলা থেকে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ পাচার হয়ে যায়। রেলগাড়ি, টেলিগ্রাফ ও ছাপাখানার প্রচলনের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়।
ইংরেজরা এদেশে ১৯০ বছর শাসন ও শোষণ করে কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। বাংলাদেশ থেকে লুটকৃত পুঁজির সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশান বাংলায়। স্থান পায় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে। এ সময় বাংলার মানুষের মাঝে ধর্ম-বর্ণ ও জাতিগত বৈষম্য সৃষ্টি হয়। পলাশী বিপর্যয়ের পর শোষিত বঞ্চিত শ্রেণী একদিনের জন্যও স্বাধীনতা সংগ্রাম বন্ধ রাখেনি। এ জন্যই বৃটিশ কর্তৃপক্ষ সাধারণ জনগণকেই একমাত্র প্রতিপক্ষ মনে করত। ফলে দীর্ঘ দুইশ’ বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রামের ফলে বৃটিশরা এদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।ৎ
কবি নজরুল ইসলাম তার ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার!’ কবিতায় লিখেছেন,
‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!/ উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।’
কাজী নজরুল ১৯২৬ সালে কবিতাটি লেখেন। ঠিক তার দুদশক পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু আমরা স্বাধীনতা লাভ করলেও পলাশীর দূরাত্মারা খোলস পাল্টিয়ে সেই বেঈমানী আর বিশ্বাসঘাতকের চরিত্রে বারবার বাংলায় তাদের আবির্ভাব হয়েছে।
কবির ভাষায়-
‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন।’
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক