০১ জুন ২০১৯, ০১:২১

ঘুরে এলাম বৃদ্ধাশ্রম

  © টিডিসি ফটো

প্রথমেই বলে নিলাম, আমার লেখাটার উদ্দেশ্য সার্থক হবে-যদি কেউ লেখাটা পড়ে উৎসাহিত হয় এবং মায়েদের দেখতে যায় এবং সহযোগিতা করে আসে। তবে শুরু করা যাক- ঘুরে এলাম বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রম কি ঘুরাঘুরির জায়গা? অবশ্যই না। ঘুরাঘুরির জায়গা হচ্ছে সেন্টমার্টিন, সাজেক, জাফলং ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ দেশের বাইরেও যায়। তবে বৃদ্ধাশ্রমে ঘুরে এসে ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলাম।

দিনটা ছিল শুক্রবার। অবসর ছিলাম যেহেতু-ভাবলাম যাই। অনেকেই তো যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সেটি দেখি। এবার সরাসরি দেখে আসি। যে চিন্তা সে কাজ। শাহবাগ থেকে আব্দুল্লাহপুর। সিটিং বাস। ভাড়া ৩৫। আব্দুল্লাহপুর নেমে একটা ওভারব্রিজ পার হলেই মৈনারটেকে যাওয়ার জন্য অটোরিক্সা/টমটম পাওয়া যায়। ভাড়া ২০। মৈনারটেকের একটু আগে জিয়াবাগ নেমে বৈকালিক স্কুলের ঠিক বাম পাশে ছোট একটা আইল ধরে ভিতরে এগুলেই পড়বে একটা দুতলা দালান।

জীর্ণ-শীর্ণ। পরিত্যক্ত। দালানের সিঁড়ি বেয়ে দুতলায় উঠলে চোখে পড়বে বৃদ্ধা মায়েদের বাসস্থান। নিচতলায় তাদের জন্য রান্নাবান্না করা হয়। বৃদ্ধ বলতে আমরা যা বুঝি। চলাফেরা করতে পারে না। এখানকার বৃদ্ধা মায়েদের অবস্থা আরো করুণ। চলাফেরা করতে না পারার দরুণ বিছানাতেই পায়খানা-প্রস্রাব করতে হয়। তবে কেউ কেউ বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারে। এগুলা পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়েছেন কিছু স্বপ্রণোদিত মজুরিবিহীন স্বেচ্ছাসেবক। ১২ জন হবে। নিতান্তই ভাল মানুষ না হলে মানুষের পায়খানা-প্রস্রাব কাজ করা যায় না। এজন্য কিছু গন্ধটন্ধ নাকে লাগতে পারে। আমার এতে সমস্যা নেই। ফ্লাটটিতে দুপাশে মোট চারটা কক্ষ।

এই বৃদ্ধাশ্রমের নাম আপন নিবাস। ২০১০ সাল থেকে চলা এই বৃদ্ধাশ্রমে এখন মায়েদের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। রাস্তায় পরে থাকা ঘর-বাড়িহীন এসব মায়েদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছেই। প্রথমদিকে ১০ জন ছিল। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালিকা সৈয়দা সেলিনা শেলি মূলত একজন দুইজন করে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন। তিনি একজন মানবাধিকার ও এনজিও কর্মী। প্রথম দিকে পরিবার থেকে বাধাবিপত্তি থাকলেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে এখনো পরে আছে নিজ হাতে গড়া আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে।

উনার সঙ্গে কথা বললাম অনেকক্ষণ। সারাদিন মানুষের কথার উত্তর দিতেও তিনি কোন ক্লান্তিবোধ করেন না। তিনি জানালেন, এখানে যারা আছে সবাই অসহায়। শুধু তাই নয়- মানসিক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, অন্ধ এমনকি রাস্তায় যৌন নিপীড়নের স্বীকার অসহায় যুবতীও আছেন।

সে এক করুণ কাহিনী। ওনার কাছে কোন সন্তান ফোন করে মা কে রেখে যেতে চাইলে তিনি নেন না। অর্থাৎ সন্তান আছে এমন বৃদ্ধা মায়েদের তিনি আনেন না। আমরা চাই না বৃদ্ধাশ্রম থাকুক, তবে যাদের মাথা গোঁজার ঠাই নাই তাদের জন্য প্রয়োজন আছে। বর্তমান সরকার বাবা-মাকে ভরণ পোষণ সংক্রান্ত আইন ২০১৩ এর গেজেট আকারে প্রকাশ করেছেন যা বাস্তবায়িত হওয়া খুবই জরুরি।

আচ্ছা নিজের মা-বাবার খেদমতের জন্য কি আইন করা লাগে? আমরা কেমন সমাজে বসবাস করি? হাদিসে আছে ‘মা-বাবার পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত’। তাছাড়া কুরআনেও বলা আছে, ‘মা বাবা যেন “উঁহু” শব্দ উচ্চারণ করে এমন আচরণ যেন না করা হয়’।

এই বৃদ্ধাশ্রমে দূর-দূরান্ত থেকে কিংবা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে অনেকেই আসেন। কেউবা আসেন ব্যক্তি উদ্যোগে। সৈয়দা সেলিনা শেলি জানালেন, অধিকাংশই আসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজ থেকে। মানে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি। আমারও তাই মনে হয়েছে। আমি থাকাকালীন একটা গ্রুপ এসেছিল “আশা” সংগঠন থেকে যাদের সবাই ছাত্র-ছাত্রী। সৈয়দা সেলিনা শেলি আরো জানালেন, এখানে অনেকেই সাহায্য সহযোগিতা করে থাকেন। রোজার মাস আসলে তা বেড়ে যায়। তবে স্থানীয়দের সহযোগিতা তেমন পান না।

সৈয়দা সেলিনা শেলি স্থানীয়দের বেশি সহযোগিতা কামনা করেন। তবে ঘটে উল্টোটা। স্থানীয় কিছু বখাটে ছেলেরা এখানে এসে চাঁদা হিসেবে করে। এ ব্যাপারে সৈয়দা সেলিনা শেলি বলেন, সব জায়গায়ই এরকম খারাপ লোক থাকে। আবার কেউবা ফাঁসাতে চান আইনের বেড়াজালে। তবে এতে তিনি চিন্তিত নন। সমস্ত বাধা মোকাবেলা করছেন শক্ত হাতে। শুধু এখানেই শেষ নয়। অনেকেই নাকি এসে ভিডিও করে। ছবি তুলে। আর সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিজেরা খেয়ে ফেলে। কেউ মারা গেলে দাফন করার জন্য গণকবরস্থানে জায়গা পাওয়া না বলে জানালেন সৈয়দা সেলিনা শেলি। এজন্য আঞ্জুমানে মফিদুলের শরণাপন্ন হতে হয়।

বৃদ্ধাশ্রমে যারা কথা বলতে পারেন এমন দু-একজন বৃদ্ধা মায়েদের সাথে কথা বলে জানা গেল, এখানে তাদের কোন অসুবিধা হয় না। খাবার-দাবার পাচ্ছেন নিয়মিত। চিকিৎসক আসেন মাসে দুয়েকবার বার। তবে এতগুলো বৃদ্ধা মায়েদের খরচ চালাতে আরো বেশি সহযোগিতার প্রয়োজন। মানুষজন দেখতে আসে। এতেই তারা খুশি। আমাদের বারবার আসতেও অনুরোধ জানালেন কেউ কেউ। যদিও হাতে বেশি সময় ছিল না। তবে পুরোটা সময় ভাল কেটেছে।

সরেজমিনে বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে আসুন, মানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন। ধন্যবাদ। যোগাযোগ: মোবা: ০১৮১৬৭৭৯১৬৩, সৈয়দা সেলিনা শেলি। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালিক, আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম, জিয়াবাগ বৈকাল স্কুলের পাশে, মৈনারটেক, আবদুল্লাহপুর, উত্তরখান, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০। ৩১/০৫/২০১৯ শুক্রবার।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়