২৯ মে ২০১৯, ১৩:৩০

বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেই?

  © ফাইল ফটো

কিছুদিন আগে ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ নামে লন্ডনভিত্তিক একটি ম্যাগাজিন এশিয়ার সেরা ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ঢাবি এই তালিকায় না থাকায় তা নিয়ে চলছে বিভিন্ন মহলে প্রবল সমালোচনা ও মন্তব্য। যেখানে শিক্ষকসহ রাজনীতিবীদ পর্যন্ত সমালোচনায় যুক্ত হয়েছেন। এ তালিকাসহ বিভিন্ন সময়ের তালিকায় ঢাবির নাম না থাকার কারণ জানার চেষ্টা করব এ লেখায়।

বিভিন্নজনের লেখায় ও বক্তব্যে এ কারণ গুলো উঠে এসেছে। বাংলাদেশে এখন ৪৩টি পাবলিক এবং ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর বাইরে আরো চারটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে এখন বিশ্বদ্যিালয়ের সংখ্যা ১৫০টি।

‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’-এর এই তালিকা তৈরিতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান আদান-প্রদান এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি- এই চারটি মৌলিক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে৷ আর তাদের এই তালিকায় এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠে এসেছে। দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং তৃতীয় অবস্থানে আছে হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। তালিকায় চীনের ৭২টি, ভারতের ৪৯টি, তাইওয়ানের ৩২টি, পাকিস্তানের ৯টি এবং হংকংয়ের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আছে। এমনকি নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে এই তালিকায়। শুধু নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।

নাম না থাকা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম অভিযোগের সুরে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানকে অর্থ না দেয়ায় এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নাম আসেনি।

এদিকের ডিনের বক্তব্য পরিষ্কার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, র‍্যাঙ্কিংকারী একটি সংস্থার একজন প্রতিনিধি তাঁদের বলেছেন, প্রয়োজনীয় তথ্য দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাঙ্কিংয়ের আওতাভুক্ত হবে। ভিসি আশার বাণী শোনালেও বসে নেই রাজনীতিবিদরা। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা আবদুল মঈন খান র‍্যাঙ্কিংয়ে না থাকার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ উল্লেখ করছেন। মোটকথা ঢাবি যে খুব একটা ভালো পজিশনে নেই তা রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট।

এখন আসি তালিকায় নাম আসার ক্ষেত্রে জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের মানদন্ড কী? কুয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) প্রতি বছর ১১টি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে। এ ১১টি মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে : প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাফল্য, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাফল্য, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন, পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক-কর্মকর্তার সংখ্যা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিনিময়ের হার।

এছাড়া আরো কিছু ফ্যাক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং তৈরীতে ভূমিকা রাখে। তার মধ্যে অন্যতম হলো– শিক্ষাক্ষেত্রে সুনাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের কর্মক্ষেত্রে সুনাম, দেশি-বিদেশি শিক্ষকদের অনুপাত এবং দেশি-বিদেশি ছাত্রদের অনুপাত। মূলত প্রাতিষ্ঠানিক খ্যাতি, শিক্ষক ও কর্মচারীদের দক্ষতা, শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভাগীয় কৃতিত্ব তথা গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানগুলো।

ঢাবির তালিকায় না থাকা এবং থাকলেও পশ্চাতে থাকা নিয়ে কারণ অনুসন্ধান করে যা জানা যায়। নষ্ট ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষকের 'দলবাজি', সাদা-নীল-গোলাপীতে বিভক্তি, শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনার কারণ, শিক্ষার্থীদের হলে থাকতে সিট পেতে রাজনৈতিক সমর্থন ফলে তারা গণরুমে থাকতে বাধ্য হন। ঢাবি বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে প্রায় অনুপস্থিত থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে গবেষণার হার কম থাকা, শিক্ষার সুনাম ক্রমাগত কমতে থাকা ও সনদ-নির্ভর গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে মূলত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা জড়িত থাকেন। কিন্তু দিন দিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত অর্থের অপ্রতুলতা, অনুকূল পরিবেশের অভাব, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাব ইত্যাদি। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উৎকর্ষের চেয়ে প্রশাসনিক দিককেই বেশি গুরুত্ব প্রদান, কিছু শিক্ষকের শিক্ষা বিমুখতা ও শিক্ষকতার চেয়ে রাজনৈতিক গ্রুপিং-লবিং, দলকানা দলদাসের রাজনীতিতে সময় বেশি দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিচিং ইউনিভার্সিটিতে পরিণত হয়েছে৷ শুধু পড়াচ্ছে৷ টার্গেট হলো শুধু বিসিএস ক্যাডার। সরকারি চাকরি। বিশ্ববিদ্যালয় কি সরকারি চাকরিজীবী বানাবার কারখানা? এটা কি ট্রেনিং সেন্টার? বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান চর্চা এবং নতুন জ্ঞানের সন্নিবেশ ও উদ্ভাবন করার জায়গা। তা কিন্তু একদমই হচ্ছে না।

ঢাবির গবেষণা খাতে অর্থের অপর্যাপ্ততা ও অর্থের সঠিক ব্যবহার না হওয়া নিয়েও রয়েছে সমালোচনা। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে গবেষণা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচীন এ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চলতি অর্থবছরে গবেষণায় বরাদ্দ পেয়েছে ১৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে গবেষণা প্রকল্প বাবদ ১৪ কোটি ও বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছে ১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ কোটি টাকা। বছর শেষে হিসাব করে দেখা গেছে, খাতটিতে ব্যয় হয়েছে আট কোটি ৪২ টাকা। সে হিসাবে গবেষণা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ৪০ শতাংশই ব্যয় করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৬৬৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়। বাজেটে গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা। হিসাবে এটি মোট বাজেটের মাত্র দুই শতাংশ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের যে বাজেট, তা আমাদের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ বছরের বাজেটের চেয়েও বেশি।

জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক গবেষণা সংক্রান্ত ব্যয় ২.৩১ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ১৯ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক গবেষণা ব্যয় ১১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। ডিউক, স্টানফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বার্ষিক ব্যয় যথাক্রমে– আট হাজার ৬৩২ কোটি, আট হাজার ৪৬৬ কোটি এবং আট হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।

শুধুমাত্র একাডেমিক সাফল্যের উপর ভিত্তি করে URAP( university ranking by academic performance) প্রকাশ করে। URAP এর ২০১৮-১৯ তালিকা বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি চমকপ্রদ। একাডেমিক দিক থেকে আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেষ্ঠ ১৫০০ এর মধ্যেই নেই। অথচ ‘URAP 1500’-তে ভারতের ৪৬টি আর পাকিস্তানের আটটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

‘QS World University Ranking’ অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয় তালিকার মধ্যে আমাদের দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও দুইটিই শ্রেষ্ঠ ৮০০ এর বাইরে। আমরা যদি ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই টপ ১০০০ এর মধ্যে তাদের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে আর টপ ৫০০ তে আছে ৯টি।পাকিস্তানের দিকে তাকালে টপ ১০০০-এ তাদের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ শিক্ষার গুনগত মান নিশ্চিত করে ঢাবির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা সময়ের দাবী। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়ব মুক্ত বাক স্বাধীনতা টিকে থাকলে জাতির টিকে থাকা সহজ হয়। উন্নয়নের মহাসড়কে যুক্ত হতে হলে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ রক্ষায় আশু পদক্ষেপ অপরিহার্য।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক