২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২:১৬

জোটের রাজনীতিতে জামায়াত ও এনসিপি : বাস্তবতা ও সম্ভাবনা

ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন  © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশের চলমান জোটের রাজনীতিতে এনসিপি ও জামায়াতের সম্পর্ককে আবেগ বা বয়ানের চেয়ে বাস্তবতা ও কৌশলের আলোকে বিশ্লেষণ করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্গানিক রাজনৈতিক উদ্যোগের সূচনা ইনকিলাব মঞ্চের মাধ্যমে শহীদ ওসমান হাদীর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল যেটি এনসিপি এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে করতে পারেনি। শহীদ ওসমান হাদী ‘জুলাই স্পিরিট’-কে ধারণ করে মাঠভিত্তিক রাজনীতি গড়ে তোলার একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা তৈরি করেছিলেন। আশা করা যায়, ইনকিলাব মঞ্চের পরবর্তী নেতৃত্ব সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।

জুলাই বিপ্লবের পর জুলাই যোদ্ধা ও সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের হাত ধরে একাধিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ও দল গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে এনসিপি। বর্তমানে এনসিপি একটি পূর্ণমাত্রার রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন রয়েছে, আলাদা প্রতীক আছে এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সাংবিধানিক সক্ষমতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে, আপ-বাংলাদেশ এখনো এই জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। ফলে রাজনীতির মাঠে এনসিপির অবস্থান তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট ও দৃশ্যমান।

রাজনৈতিক দল হওয়ার অর্থ কেবল বক্তব্য দেওয়া নয়; নির্বাচনে যাওয়া, আসন পাওয়া এবং সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার চেষ্টা করা চুড়ান্তভাবে জনগণের কল্যাণে এবং দেশের অগ্রগতিতে অর্থবহ ভূমিকা রাখা।  

এই জায়গায় এসে এনসিপির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হয়। দলটির নেতৃত্ব ও কর্মীদের বড় একটি অংশ ডানপন্থী ও ইসলামপন্থী চিন্তাধারার, একটি ক্ষুদ্র অংশ বামপন্থী এবং আরেকটি অংশ মধ্যমপন্থী। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায়শই ত্রিমুখী দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ঘটে, যা একদিকে গণতান্ত্রিক হলেও অন্যদিকে কৌশলগত সিদ্ধান্তে জটিলতা তৈরি করে।

জামায়াত ইস্যুতে এনসিপির ভেতরে ও বাইরে ভিন্ন ভিন্ন বয়ান থাকলেও বাস্তবতা হলো- জুলাই স্পিরিটকে রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখতে এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হতে হলে জামায়াতের সঙ্গে জোট ছাড়া এনসিপির সামনে এই মুহূর্তে কার্যকর কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি এখনো জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। উপরন্তু, বিএনপির পক্ষে এনসিপিকে তাদের চাহিদামতো আসন দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। এটা কেবল বিএনপির সীমাবদ্ধতা নয়, বরং বর্তমান সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতা।

অন্যদিকে, জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে এনসিপির তুলনামূলকভাবে বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কমপক্ষে দশজন এমপি সংসদে যেতে পারলে এনসিপি সংসদের ভেতরে ও বাইরে জুলাই স্পিরিট, জুলাই সনদ এবং সংস্কারের প্রশ্নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। একবার সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের রাজনীতি প্রধানত সংসদকেন্দ্রিক হয়ে যাবে। 

প্রথম তিন বছর সংসদের বাহিরে রাজনীতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর একটি গণতান্ত্রিক পাইলে, সরকার মোটামুটি ভালো চালাইলে দেশের মানুষ সহজে সরকারের বিরুদ্ধে যাইতে চাইবেনা। একটা কমন সেটআপ হলো- ভালো না করলে ৫ বছর পর ভোটে হারিয়ে দিবে। মাঝপথে খুব ক্রিটিকালিটি তৈরি না হলে দেশের মানুষ সরকার ফেলে দিতে মাঠে নামার সম্ভাবনা কম থাকবে।  সেই বাস্তবতায় সংসদের বাইরে থাকা মানে ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিকতা চলে যাওয়া। তবে হ্যাঁ, ভিতর ও বাহিরে অবস্থান থাকলে এনসিপির রাজনীতি ভালো দাঁড়াবে।

এটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের বাইরে থাকলে ১৯৭১-এর ইস্যু দিয়ে আর কেউ বড় রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারবে না। বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে ভোটের একমাত্র নির্ধারক হিসেবে দেখে না, ভবিষ্যত নির্বাচনেও দেখবে না বলে ধরে নেয়া যায়। বরং বিগত পনেরো বছর ধরে ১৯৭১-এর বয়ান ব্যবহার করে যে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে, তা সমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনীতির জায়গা তৈরি করতে হলে ভিন্ন বাস্তবতা মাথায় রেখেই এগোতে হবে।

জামায়াতের সঙ্গে জোটে গেলে এনসিপির নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় ও সাংগঠনিক শক্তি দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। বিপরীতে, বিএনপির সঙ্গে গেলে পুরো দলটি বিএনপির রাজনৈতিক ছায়ার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার বাস্তব ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজস্ব ‘স্টেক’ নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত এনসিপির জন্য জামায়াতের সঙ্গে থাকা কৌশলগতভাবে অধিক যুক্তিসংগত।

বাস্তবতা হলো- পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছেছে; বিএনপি স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগ ও জামায়াতের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগিয়ে এবং কাঠামো ব্যবহার করে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।  এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা অস্বীকার করে বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝা যায় না।

অতএব, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এনসিপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি দাঁড় করানোর জন্য জামায়াতের সঙ্গে জোটই সবচেয়ে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পথ। এটি আদর্শিক জোট নয়, বরং এটি হবে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার এবং  প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। এতে উভয় দলেরই জন্য লাভজনক বিষয় রয়েছে। দেখা যাক, জামায়াত ও এনসিপি নেতৃবৃন্দ কী সিদ্ধান্ত নেয়...

লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিলাল হোসাইন, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, ইউটিএল