নুরের উপর আক্রমণ ঢাবির অবমাননা

  © টিডিসি ফটো

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উঠা আসা নুরুল হক নুর এখন যেনতেন কোনো ব্যক্তি নয়। নুরের আন্দোলন জীবনের দুটো অংশ। প্রথমত; কোটা সংস্কার আন্দোলন তথা ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হবার পূর্ব কাল এবং দ্বিতীয়ত; বর্তমান ডাকসুর ভিপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ হতে আজ অবধি। ভুলে গেলে চলবে না কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তার উপর অসংখ্য বার পৈশাচিক শারীরিক আক্রমণ হয়েছে। তারপরেও সে দমিয়ে যায়নি।

মূলত নুরের নেতৃত্বে আন্দোলনের কারণে অভিশপ্ত কোটা ব্যবস্থা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও কার্যকারিতা এখনো দৃশ্যমান নয়। সেই সময়ে তার উপর আক্রমণ যেমন নিন্দিত হয়েছে ক্ষুদ্র একটি মহলের কাছে নন্দিত হয়েছে। যদিও এই সংখ্যা খুবই নগন্য।

সুস্থ বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ কখনো কারো ওপর আক্রমণের দৃশ্য অবলোকন করে পৈশাচিক সুখ অনুভব করতে পারে না। যদিও নুরের উপর আক্রমণের পর পৈশাচিক সুখে অবগাহন করে কেউ কেউ সুখানুভূতি পেয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল একটি যৌক্তিক আন্দোলন। যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। ক্রমান্বয়ে দানা বেঁধে ওঠা সেই আন্দোলনকে কূটকৌশলে এবং বাজেভাবে বানচাল করার যথেষ্ট অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে না পেরে তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়।

এসব ঘটেছে সেই সময়ের নেতৃত্বে থাকা নুরের ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতা, যৌক্তিক উপস্থাপন ও দক্ষ নেতৃত্বের গুনে। রাতারাতি হিরো বনে যাওয়া নুরের জন্য এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। দুর্গম পথ বেয়ে ঢাবির শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সর্বোচ্চ ফোরামের সর্বোচ্চ পদে নুর এখন সমাসীন। ডাকসু নির্বাচনের দিনেও রোকেয়া হলে তার বিরুদ্ধবাদীরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।

২৮ বছর পরে ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত ডাকসুর বিতর্কিত সেই নির্বাচনে দিনশেষে গভীর রাতে তাকেই ডাকসুর ভিপি হিসেবে জয়ী ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষ অনেকটা বাধ্য হয়েছে। নুরুল হক নুর ১১ হাজার ৬২ ভোট পেয়ে ভিপি নির্বাচিত হয়। যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতো তাহলে ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো।

এরপরের ইতিহাসটা কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা। ডাকসুর একজন ভিপি মানে ঢাবির ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর অভিভাবক তথা কান্ডারি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সম্মুখ সারির লড়াকু সৈনিক। তার পদমর্যাদা ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচিতদের মধ্যে শীর্ষেও। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষিতে তার পদ ও পদমর্যাদা অনেক উপরে। যারা অতীতে ডাকসুর ভিপি ছিলেন তাদের অতীতের ভূমিকা ও বর্তমান কর্মকান্ড দেখে তা কিছুটা হলেও অনুমেয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ও নুরুল হক নুর এর প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে এবং মৌন সমর্থন ছিল বিস্তর। যা দৃশ্যমান ছিল কোটা সংস্কারের বিভিন্ন আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি। এ সমর্থনের কারণেই আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল শহর বন্দর থেকে মফস্বল পর্যন্ত।

তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগ অনুভূতি বুঝতে পেরেছিল। সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনের ভাবনাগুলো বুঝতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অদৃশ্য কোনো ইশারায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অংশগ্রহণ না করে বরং আন্দোলন বানচালের হেন কোন কার্যকলাপ নেই যা তারা করেনি।

সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের এ কার্যকলাপ সাধারণত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে। সেই সুযোগটি লুফে নিয়েছে হঠাৎ করে গঁজিয়ে উঠা সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। যার প্রতিফলন এতো অনিয়ম অব্যবস্থাপনার পরও ডাকসুর ভিপি ও মেয়েদের হলে তাদের চমকপ্রদ ফলাফল। একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হয়েও এ ফলাফল সাধারণ শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের চাওয়া বললে অতিরঞ্জিত বলা হবে না।

পলিটিক্সে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারতে হয়। বৃষ্টির দিকে ছাতা মেলিয়ে ধরতে হয়। বৈপরীত্য দেখালে ধরাশায়ী আবার কখনো কখনো শয্যাশায়ীও হতে হয়। রাজনীতি বড়ই অদ্ভূত জিনিষ এবং কখনো আবার অনিশ্চিত গন্তব্যে ছুটে চলতে হয়। পদ-পদবী মানুষের ভালোবাসা কখন জুটবে বলা মুশকিল। তবে জনগণের পাশে থাকলে ভালোবাসা নিরন্তর। বাকি কিছুটা নেতা-নেত্রীর নেক নজরে পড়ার উপরে যদিও নির্ভরশীল।

নুরের নেক নজরের প্রয়োজন হয়নি। সাধারণদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সে এখন অসাধারণ। নুর ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত ভিপি। চল্লিশ হাজার ছাত্রের সে প্রতিনিধি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুখে, দুখে নুর এখন ভরসা ও আশ্রয়স্থল। যারা নুরকে ভোট দিয়েছে কিংবা দেয়নি সে সবার অভিভাবক। তার পদমর্যাদাও এখন সবার ওপরে। নুর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ কোনো ব্যক্তি নয়। তার সংগঠনও নিষিদ্ধ নয়। নুর বরং হেলাল হাফিজের নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতার পংক্তিমালা-

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

নুর তো চুরি ডাকাতি করতে নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার সচেতন করতে বি-বাড়ীয়া গিয়েছিল গত পরশু। তার নির্ধারিত ইফতার মাহফিল করতে দেওয়া হয়নি। গতকাল বগুড়ায় তার উপর শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হলো! ঢাকায় ফেরার পথে তার অ্যাম্বুলেন্সে ট্রাক দিয়ে আঘাত করা হলো। নুরের উপর এসব আক্রমণ কিসের লক্ষণ? ভিন্ন মত পথের ব্যক্তিদের এভাবে হয়রানির মনে কি? নুরের উপর আক্রমণ মানে ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ নয় কি?

নুর তো সাধারণত শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত ভিপি। তার অপমান মানে ঢাবিয়ানদের অপমান নয় কি? এতটুকু বুঝতে অন্তত আমাদের দেরি হবার কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিকতার চাষাবাদ হয়। প্রগতির উন্মেষ ঘটানো হয়। উদারতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রগতির পথ দেখানো হয়। ঢাবি এখন কোনটির উপর অটল ও অবিচল বলতে পারেন কি?

অতীতের গৌরব ৫২,৭১ নিয়ে বহু গর্ব করি। বুকের ছাতী টান টান করে আস্ফালন করি। আমরা গৌরবের কি করেছি? কি দিতে পেরেছি? বরং অতীতের গৌরবটুকুও হারাতে বসেছি। হলে একটি সিটের জন্য নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বিবেকহীনদের দলে নাম লিখিয়েছি। মানবিক হবার স্বপ্ন আশা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিপক্ষের উপর নিষ্ঠুর হয়েছি।

যাই বলেন আপনার মুখে ঢাবির গৌরবের গালগল্প এক্কেবারে বেমানান ও আপত্তিকর। দলদাস দলকানা হয়ে আপনি বিবেকবোধ বর্জিত জড় পদার্থ এখন। নুরের উপর আক্রমণ আপনার মনকে আন্দোলিত করতে পারবে না। কারণ আপনি অনেকটাই এখন নির্জীব নির্বাক। অনুভূতিহীন ঘুমন্ত। বাইরের চিৎকার কোলাহল আপনাকে জাগাতে পারবে না। কারণ আপনি আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত।

মানবতা, মানবিকতা আপনার কাছে অপরিচিত শব্দ গুচ্ছ। অনেক শক্ত এবং পোক্ত কথার অবতরণা করলাম। এ নিরবতার দায় আপনি, আমি কেউ এড়াতে পারি না। আইনস্টাইনের ভাষায় বলতে হয়, ‘The world will not be destroyed by those who do evil, but by those who watch them without doing anything about it.’

শেষ করি কাজী নজরুল ইসলামের অমর কবিতা দিয়ে -

‘আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা
রাত পোহাবে তবে৷’

লেখক: শিক্ষক, গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ