তারেক রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আজ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু দিন আছে- যেগুলো কেবল তারিখ হিসেবে নয়—জাতির সামষ্টিক স্মৃতিতে একটি গভীর ‘ঐতিহাসিক সংকেত’ হিসেবে গাঁথা। ২৫ ডিসেম্বর(২০২৫) তেমনই একটি দিন হয়ে উঠতে যাচ্ছে। কারণ ওই দিন লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। এটি কোনো ব্যক্তিগত বা দলীয় ঘটনা মাত্র নয়; বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন, রাজনৈতিক ভারসাম্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক আস্থার পুনরুদ্ধার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং জাতীয় ঐক্যের সম্ভাব্য সূচনাবিন্দু। সাম্প্রতিক বক্তব্যে তারেক রহমান নিজেই ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার সিদ্ধান্তের কথা নিশ্চিত করে বিমানবন্দরে ভিড় না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। এই আহ্বান কেবল শৃঙ্খলার প্রশ্ন নয়; এটি তাঁর প্রত্যাবর্তনকে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ ও রাজনৈতিক পরিমিতিবোধের সঙ্গে যুক্ত করার একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করে।
এই প্রত্যাবর্তনের রাজনৈতিক তাৎপর্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশ একটি স্পষ্ট রূপান্তরপর্বে প্রবেশ করে। ট্রানজিশনাল রাজনীতির স্বভাবই হলো—এটি একই সঙ্গে আশা ও অনিশ্চয়তা বহন করে; কারণ পুরোনো ক্ষমতার কাঠামো ভেঙে পড়ে, কিন্তু নতুন স্থিতাবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে ওঠে না। এই মধ্যবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় এমন একটি কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, যা অস্থিরতা নয়—বরং জবাবদিহি ও ভারসাম্য সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বাস্তবতায়, যেখানে বৃহৎ দলগুলোর সক্রিয় উপস্থিতিই রাষ্ট্রীয় গতিপথ নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে, সেখানে প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দেশের ভেতরে সক্রিয় অবস্থান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের একটি অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু দিন থাকে—যা কেবল ক্যালেন্ডারের পাতায় আটকে থাকে না; জাতির মনের ভেতর তা একটি “ঐতিহাসিক সংকেত” (historical signal) হয়ে ওঠে। ২৫ ডিসেম্বর তেমনই একটি দিন হয়ে উঠবে। কারণ সেদিন লন্ডন থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুধু একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফেরা নয়; এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন, রাজনৈতিক ভারসাম্য, অর্থনৈতিক আস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং জাতীয় ঐক্যের—একটি সম্ভাব্য যুগসন্ধিক্ষণ। সাম্প্রতিক সংবাদে তারেক রহমান নিজেই ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফেরার কথা নিশ্চিত করেছেন এবং বিমানবন্দরে ভিড় না করার অনুরোধ করেছেন—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা, কারণ তিনি তাঁর প্রত্যাবর্তনকে “শৃঙ্খলা ও আন্তর্জাতিক ইমেজ”-এর সঙ্গে যুক্ত করছেন।
এই প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব আরও গভীর হয়ে ওঠে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায়। ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ৮ আগস্ট ২০২৪-এ—দেশ তখন একটি “ট্রানজিশনাল পিরিয়ড” বা রূপান্তরপর্বে প্রবেশ করে। ট্রানজিশনাল পলিটিক্সের বৈশিষ্ট্য হলো—এ সময় রাষ্ট্রব্যবস্থা একইসঙ্গে আশা ও উদ্বেগ দুটো বহন করে; কারণ পুরোনো ক্ষমতা কাঠামো ভাঙে, কিন্তু নতুন স্থিতি সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয় না। এই মধ্যবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন হয় ফাংশনাল পলিটিক্যাল কম্পিটিশন—যে প্রতিযোগিতা অস্থিরতা তৈরি না করে জবাবদিহি সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে বড় দলগুলোর উপস্থিতিই রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রধান চালিকা, সেখানে বড় বিরোধী দলের প্রধান নেতৃত্বের দেশভিত্তিক উপস্থিতি রাজনৈতিক ভারসাম্য ও রাষ্ট্রীয় স্থিতির এক বড় উপাদান হয়ে ওঠে।
রাজনীতি ও অর্থনীতি আলাদা নদী নয়—একই স্রোতের দুই ধারা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে “পলিটিক্যাল স্ট্যাবিলিটি” (political stability) এক ধরনের অদৃশ্য অবকাঠামো। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, রপ্তানি, ব্যাংকিং—সবকিছুর ভিত্তিতে থাকে আস্থা (confidence)। আর আস্থা গড়ে ওঠে তখনই, যখন রাষ্ট্রে নিয়মতান্ত্রিকতার ধারণা শক্ত হয়; নীতির ধারাবাহিকতা থাকে; এবং বিরোধী রাজনীতিও কার্যকর থাকে। ফলে তারেক রহমানের ফিরে আসা কেবল দলীয় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে না—এটি জাতীয় অর্থনীতিতেও একটি সিগন্যাল ইফেক্ট সৃষ্টি করতে পারে: “দেশ রাজনৈতিক ভারসাম্যে ফিরছে, প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক হচ্ছে, সিদ্ধান্ত–প্রক্রিয়া আরও জবাবদিহিমূলক হতে পারে।”
বাংলাদেশ আজ যে অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা করছে, তা অনেকাংশে পলিটিক্যাল ইকোনমি ক্রাইসিস। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা, বাজার অস্থিরতা, ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা, ডলার ও আমদানি ব্যয়, কর্মসংস্থানের সংকট—এসবের কেন্দ্রে আছে প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা ক্ষয়। আস্থা ক্ষয় হলে বিনিয়োগ স্থবির হয়, নতুন কর্মসংস্থান কমে, বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয় এবং বৈদেশিক অংশীদাররা সতর্ক হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বড় কাজ হলো “কনসেনসাস বিল্ডিং” (consensus building)—যাতে অর্থনৈতিক নীতিগুলো শুধু দলীয় নীতিতে আটকে না থেকে জাতীয় কৌশল হয়ে ওঠে।
এই জায়গাতেই তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের রাজনৈতিক তাৎপর্য গভীর। বাংলাদেশের বহুদলীয় কাঠামোতে বিএনপি একটি বড় জনপ্রিয় দল—এবং বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দেশি উপস্থিতি মানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন গতি। গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতা মানে শত্রুতা নয়; বরং প্রতিযোগিতা মানে নীতির বিকল্প উপস্থিতি। যেখানে বিকল্প নেই, সেখানে রাষ্ট্রের ভেতরে হেজেমনিক প্রবণতা (hegemonic tendency) বাড়ে; এবং হেজেমনিক ব্যবস্থায় বাজারে “ক্রোনি ক্যাপিটালিজম” (crony capitalism) তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে—যেখানে যোগ্যতার বদলে ঘনিষ্ঠতা প্রাধান্য পায়। “ক্রোনি ক্যাপিটালিজম”- এমন একটি অর্থনৈতিক পরিবেশ, যেখানে বাজারের প্রতিযোগিতা বিকৃত হয়; ফলে প্রকৃত উদ্যোক্তা, ছোট ব্যবসা, এবং দক্ষ তরুণরা ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন যদি রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করে, তবে অর্থনীতিতেও “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” (level playing field) নিয়ে জাতীয় বিতর্ক জোরদার হবে—এবং সেটাই দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির স্বাস্থ্যকর পুনর্গঠনের সূচনা হতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেন “অর্থনৈতিক উন্নয়নের” সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত? কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেবল অর্থনীতিবিদদের কাজ নয়; এটি মূলত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফল। উদাহরণস্বরূপ, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করতে হয়; ব্যাংকিং স্থিতিশীল করতে হলে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে হয়; অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শক্তিশালী নজরদারি ও জবাবদিহি দরকার; জবাবদিহি আসে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে। ফলে রাজনৈতিক ভারসাম্য ফিরলেই অর্থনীতির ভিত শক্ত হয়। এ কারণেই গণতন্ত্রকে অনেক দেশে বলা হয় “ইকোনমিক স্ট্যাবিলাইজার”—যখন তা কার্যকর থাকে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স একটি বড় স্তম্ভ। রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রা নয়—এটি গ্রামীণ অর্থনীতি, আবাসন, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং সামাজিক নিরাপত্তারও চালিকা। কিন্তু রেমিট্যান্সকে যদি উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে রূপান্তর করা যায়, তখন তা উন্নয়নের শক্তিশালী ইঞ্জিন হয়। এই জায়গায় “ডায়াসপোরা ইকোনমি” (diaspora economy) ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের আড্ডায় তারেক রহমানের নাম উচ্চারিত হয় সবসময়। তারেক রহমান দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে প্রবাসী নেটওয়ার্ক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন—এমন যুক্তি তাঁর সমর্থকেরা দেন। এই অভিজ্ঞতা যদি নীতিতে রূপ নেয়—ডায়াসপোরা বন্ড, প্রবাসী বিনিয়োগ প্রণোদনা, দক্ষ শ্রমিক রপ্তানির উন্নত কৌশল, অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা—তবে অর্থনীতির জন্য এটি লাভজনক হতে পারে। সুতরাং তাঁর প্রত্যাবর্তনকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হিসেবে দেখা যায়—কারণ নীতিকে বাস্তবায়নের জন্য দেশে উপস্থিতি, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হলো আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। অর্থনীতি স্থিতি পায় নিরাপত্তার ওপর। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার বিভিন্ন খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে; এমনকি সংবাদপত্র অফিসে হামলা, সহিংসতা, অস্থিরতা—এসব বিষয়ও উঠে এসেছে। এগুলো দেখায়—ট্রানজিশনাল সময় শুধু রাজনৈতিক বিতর্ক নয়, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার পরীক্ষাও। এই অবস্থায় বড় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়—কারণ জনগণ চায় রাষ্ট্রে “অথরিটি” ফিরে আসুক, কিন্তু সেটি যেন দমন নয়—বরং নিয়ম ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে আসুক। একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন শৃঙ্খলার পক্ষে কথা বলে এবং নিজ দলের ভেতরও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে, তখন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মনোবল ফিরে পায়—এটি রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের বাস্তব পর্যবেক্ষণ।
আমার এ লেখার একটি বড় থিম হচ্ছে- “ফিজিক্যাল উপস্থিতি বনাম ভার্চুয়াল উপস্থিতি।” সত্যিই ডিজিটাল যুগে দূর থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব—তারেক রহমান বহু বছর সেটাই করেছেন বলে তাঁর সমর্থকেরা মনে করেন। কিন্তু একটি বড় রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচনের দিকে এগোয়, তখন মাঠপর্যায়ের উপস্থিতি একটি আলাদা শক্তি। কারণ নির্বাচনের সময় কাজ করে “গ্রাসরুট মবিলাইজেশন” (grassroots mobilization)। গ্রাসরুট মবিলাইজেশন মানে—ইউনিট অফিস, ওয়ার্ড, থানা, উপজেলা, জেলা—সব স্তরে কর্মীদের সমন্বিত কাজ। এই কাজকে বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলিত করতে মাঠে নেতৃত্ব দরকার। ফলে দেশে ফিরে তারেক রহমান যদি সরাসরি সংগঠন পুনর্গঠন করেন, দলীয় অনিয়ম–অভিযোগে দ্রুত ব্যবস্থা নেন, মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের নিয়ে কাজ করেন, তাহলে দলীয় ইমেজও বৃদ্ধি পেতে পারে। কিছু মনোনয়ন বঞ্চিত নেতার আচরণে দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ হতে পারে; এই ঝুঁকি সব বড় দলে থাকে। কিন্তু এই ঝুঁকি কমাতে দলীয় প্রধানের কঠোর “ইন্টারনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি” (internal accountability) জরুরি। সে কাজ দেশে থেকে দ্রুত করা সম্ভব।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের আরেকটি দিক হলো “ন্যাশনাল ইউনিটি” (national unity) ও “সিম্বলিক পলিটিক্স” (symbolic politics)। বাংলাদেশের রাজনীতি আবেগপ্রবণ; এখানে প্রতীক খুব দ্রুত জনমনে প্রভাব ফেলে। তারেক রহমানের দীর্ঘ নির্বাসন, পরিবার–ঐতিহ্য, দলীয় স্মৃতি—সব মিলিয়ে তাঁর ফেরা একটি প্রতীকী ঘটনা। কিন্তু প্রতীক যদি কৌশলে রূপ না নেয়, তাহলে তা ক্ষণস্থায়ী হয়। এ কারণে তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে—ফেরার পর তিনি কীভাবে প্রতীককে নীতিতে রূপ দেন: অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, সংস্কার, নির্বাচন, দলীয় শৃঙ্খলা—এসবকে কীভাবে একটি রোডম্যাপে আনেন।
এখানে একটি মানবিক বাস্তবতাও আছে- ২৩ নভেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ২০২৫ সালের ৬ মে তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন; এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ও জনসমাগম নিয়ে ব্যাপক সংবাদ হয়েছে। ওই ঘটনাটি দেখিয়েছে—বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে মানুষের আবেগ কীভাবে যুক্ত। একজন অসুস্থ মায়ের পাশে সন্তানের থাকা নিছক রাজনৈতিক ইস্যু নয়—এটি সামাজিক ও মানবিক ইস্যু। “হিউম্যানিটারিয়ান লেজিটিমেসি” (humanitarian legitimacy) শব্দটি এখানে গ্রহণ করা যেতে পারে। এটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। কারণ মানবিকতা রাজনীতির শত্রু নয়; বরং মানবিকতা রাজনীতিকে নৈতিক শক্তি দেয়। তারেক রহমানের ফেরা তাই কেবল রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য নয়—এটি একটি পরিবারের মানবিক পুনর্মিলনের বার্তাও বহন করে, যা সমাজে প্রশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
তবে সবচেয়ে সংবেদনশীল ও জরুরি প্রসঙ্গ হলো নিরাপত্তা। বারবার বলা হচ্ছে তাঁকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে। এটি খুবই বাস্তব দাবি। কারণ বড় রাজনৈতিক নেতার প্রত্যাবর্তন “ক্যারিসম্যাটিক মবিলাইজেশন” (charismatic mobilization) তৈরি করে—জনসমাগম বাড়ে, উত্তেজনা বাড়ে, ঝুঁকিও বাড়ে। নিরাপত্তা ব্যর্থ হলে শুধু ব্যক্তি নয়—রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে VVIP সিকিউরিটি প্রটোকল, ক্রাউড কন্ট্রোল, ইমার্জেন্সি রুট, গোয়েন্দা সমন্বয়, এবং গুজব–নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। তারেক রহমান নিজেই বিমানবন্দরে ভিড় না করতে অনুরোধ করেছেন—এটি নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার দিক থেকে ইতিবাচক। ড. ইউনূস সরকার তারেক রহমানের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে নিরাপত্তার প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে একটি বিষয় মনে রাখতে হয়—এখানে কোনো দল বা গোষ্ঠীকে “প্রমাণ ছাড়া” দায়ী করা উচিত নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় কৌশল হিসেবে বলা যায়: ট্রানজিশনাল সময়ের অস্থিরতায় ‘বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী’ পরিস্থিতি কাজে লাগাতে পারে; উসকানি, গুজব, কিংবা সহিংসতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে পারে। তাই ঝুঁকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের কৌশল হতে হবে পেশাদার, আইনভিত্তিক এবং নিরপেক্ষ। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে কেবল একজন ব্যক্তিকে রক্ষা করা নয়—এটি আসলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক স্থিতি ও অর্থনৈতিক আস্থা রক্ষা করা।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাত্রাও যুক্ত। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে। সাম্প্রতিক সময়েই বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক উত্তেজনা ও নিরাপত্তা উদ্বেগ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ এসেছে; যেহেতু নির্বাচনের সময়সূচিও উল্লেখ হয়েছে(১২/২/২০২৬)। এসব ইঙ্গিত করে—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন কেবল অভ্যন্তরীণ নয়; এটি আঞ্চলিক কূটনীতির সঙ্গেও সংযুক্ত। এ অবস্থায় একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা বাড়ায়—রপ্তানি বাজার, বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা—সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ফলে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন যদি নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ করে তুলতে সহায়ক হয়, তবে সেটি আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশের লাভ।
এখন প্রশ্ন “তারেক রহমান কি দেশে ফিরলেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে?”—এ প্রশ্নের উত্তর বাস্তববাদী হতে হবে। কোনো ব্যক্তি একা একটি রাষ্ট্র বদলে দিতে পারে না। কিন্তু ইতিহাস বলে—কিছু ব্যক্তি এমন সময় ফেরেন, যখন তাদের উপস্থিতি একটি বৃহৎ প্রক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ ব্যক্তি হয় ক্যাটালিস্ট (catalyst)। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায়—নেতৃত্বের দৃশ্যমানতা, বিরোধী রাজনীতির কার্যকর উপস্থিতি, নির্বাচনমুখী সমঝোতা, দলীয় শৃঙ্খলা—এসব বিষয়ে তারেক রহমান একটি ক্যাটালিস্ট হতে পারেন। কিন্তু এই ক্যাটালিস্ট কাজ করবে তখনই, যখন তিনি তিনটি বিষয়ে সফল হবেন: এক—দলের ভেতরে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা, দুই—জাতীয় পর্যায়ে ঐকমত্য ও সহনশীলতা,
তিন—অর্থনীতি ও প্রশাসনে বাস্তব নীতির রোডম্যাপ। এই তিনটি শর্ত পূরণ হলে তাঁর প্রত্যাবর্তনের “রোমান্টিক আখ্যান” বাস্তব রাষ্ট্রচিন্তায় রূপ নেবে।
বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে অর্থনীতির তিনটি ফ্রন্টে কাজ করতে হবে: (১) মূল্যস্ফীতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ, (২) কর্মসংস্থান ও উৎপাদন, (৩) ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ আস্থা। এই তিন ফ্রন্টে রাষ্ট্রকে শক্ত হতে হয়, কিন্তু সেই শক্তি যেন স্বেচ্ছাচার না হয়—বরং নিয়ম ও জবাবদিহির শক্তি হয়। একটি শক্তিশালী রাজনীতি থাকলে বর্তমান সরকারও ভুল কম করবে—কারণ প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হয়। এখানেই গণতন্ত্র অর্থনীতির সহায়ক। তারেক রহমানের উপস্থিতি যদি রাজনীতিকে প্রতিযোগিতামূলক ও নিয়মতান্ত্রিক করে তোলে, তাহলে অর্থনীতিও স্বাভাবিক হতে শুরু করবে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দরকার “ইনস্টিটিউশনাল ট্রাস্ট” (institutional trust)। জনগণ যদি মনে করে আইন সবার জন্য সমান, প্রশাসন নিরপেক্ষ এবং নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য—তবেই তারা রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করে। সহযোগিতা ছাড়া রাষ্ট্র চলে না। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে রাজনীতিকে পরিণত হতে হয় ইনক্লুসিভ গভর্ন্যান্স (inclusive governance)–এ। এক পক্ষকে বাদ দিয়ে অন্য পক্ষকে জিতিয়ে স্থিতি আসে না; বরং নতুন সংকট জন্ম নেয়। তাই তারেক রহমানের ফিরে আসা যদি রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ায়, তাহলে তা রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে।
সবশেষে, ২৫ ডিসেম্বরকে শুধু “ফেরার দিন” হিসেবে দেখলে আমরা ভুল করব। এটিকে দেখতে হবে “প্রক্রিয়ার সূচনা” হিসেবে। ফেরার দিন জনসমাবেশ হবে, আবেগ থাকবে, রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া থাকবে—এগুলো স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরদিন থেকে শুরু হবে বাস্তব কাজ: দলীয় পুনর্গঠন, শৃঙ্খলা, নীতিগত প্রস্তাবনা, নির্বাচনি প্রস্তুতি এবং জাতীয় সংলাপ। সেখানেই হবে আসল পরীক্ষা—কারণ রাষ্ট্রের ইতিহাস আবেগের পাতায় নয়, সিদ্ধান্তের পাতায় লেখা হয়।
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তাই একদিকে জাতীয় আবেগের বিষয়, অন্যদিকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সম্ভাবনার নাম। তিনি যদি সত্যিই “টেক ব্যাক বাংলাদেশ” বা রাষ্ট্রকে নতুন করে দাঁড় করানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, তবে তাঁর কাছে জনগণের প্রত্যাশা হবে—তিনি প্রতিশোধ নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন; প্রতীক নয়, নীতি দেবেন; বিভাজন নয়, ঐকমত্য তৈরি করবেন; এবং ক্ষমতার রাজনীতি নয়, রাষ্ট্রগঠনের রাজনীতি করবেন। এই চারটি মানদণ্ডই ঠিক করবে—২৫ ডিসেম্বর কেবল একটি দিন, নাকি সত্যিই একটি নতুন যুগের সূচনা।
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে ড. ইউনূস সরকারের ট্রানজিশনের ক্লান্তি, অন্যদিকে ভবিষ্যতের অপেক্ষা। এই অপেক্ষার মাঝেই ২৫ ডিসেম্বর একটি সম্ভাব্য নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি বহন করছে—যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব দায়িত্বশীল হয়, যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিরপেক্ষ থাকে, যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া অংশগ্রহণমূলক হয়, এবং যদি সহিংসতা–গুজব–উসকানি ঠেকিয়ে জাতীয় ঐক্য বজায় থাকে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা তখন কেবল বিএনপির জন্য নয়—বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্যও একটি বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। আর সেই কারণেই—রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে তাঁকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সুরক্ষিত রাখা এবং গণতন্ত্রকে বাস্তব পথে ফিরিয়ে আনা।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়